রবীন্দ্রনাথের পতিসর: কৃষকের চোখে মুক্ত অর্থনীতি

রিফাত হোসাইন সবুজ

by sondeshbd.com
33 views

পতিসর: যেখানে কৃষকের চোখে আলো জ্বালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বরেন্দ্রভূমি উত্তরের জনপথ নওগাঁর আত্রাই উপজেলার পতিসর ছিল বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিন্তা ও পল্লী উন্নয়ন তত্ত্বের এক বাস্তব পরীক্ষাগার। কবি তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার কৃষকের মুক্তি কোনো ব্যক্তিগত দয়া বা দান-খয়রাতের মাধ্যমে সম্ভব নয়; দরকার সংগঠিত উদ্যোগ, শিক্ষার প্রসার, সমবায় ব্যবস্থা এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার।

১৮৯১ সালে পতিসরে এসে তিনি গ্রামের দারিদ্র‍্য, অশিক্ষা ও কৃষকদের শোষিত জীবনের যে চিত্র দেখেছিলেন, তা তাঁর মনোজগতে গভীর রেখাপাত করে। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি লিখেছিলেন—
“যেখানে পারো, এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ কর; শিক্ষা দাও, কৃষি-শিল্প ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ কর।

কৃষকের দুঃশাসনের মূল কারণ যে মহাজনী ঋণব্যবস্থা, কবি তা খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ১৯০৫ সালে তিনি ঋণ করে প্রথম ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থও তিনি এই ব্যাংকের তহবিলে যুক্ত করেন। যাতে গরিব প্রজারা স্বল্পসুদে ঋণ পায় এবং মহাজনের শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারে।

এর ফলে মহাজনী ঋণের দাসত্ব থেকে কালীগ্রাম পরগনার মানুষ মুক্ত হয়,
গ্রামে কৃষিকাজে স্বস্তি ফিরে আসে ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মায়। যার ফলে অর্থনৈতিক প্রবাহ তৈরি হয় ও স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন অর্থবিত্তের সঙ্গে শিক্ষার অঙ্গীভূত সম্পর্ক আছে। তাই কৃষি ব্যাংকের পাশাপাশি তিনি শিক্ষার প্রসারকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

কবির বিশ্বাস ছিল অশিক্ষা কৃষকের সর্বনাশের মূল। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি প্রায় ২০০টি অবৈতনিক পাঠশালা এবং ৩টি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পাশাপাশি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার ঘটিয়েছিলেন।
কৃষির উন্নয়নে তিনি যে যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল, কলের লাঙলসহ আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার,
উন্নত বীজ ও উন্নত চাষপদ্ধতি প্রচলন,

তাঁত, মৃৎশিল্প, রেশম ও অন্যান্য কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ ও ঋণসহায়তা।
দারিদ্র‍্য বিমোচনের লক্ষ্য থেকে এসব ক্ষেত্রেও তিনি সমবায় ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষিকাজে স্বনির্ভরতা ও আর্থিক স্থিতি এনে দেয়। কৃষির আধুনিকায়ন ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। পতিসরের কৃষকদের উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করতে তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমেরিকায় কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য পাঠান। পরবর্তীতে পতিসরে তিনি ট্রাক্টরসহ আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার চালু করেন এবং কৃষকদের হাতে-কলমে নতুন চাষাবাদ পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেন। যা সে সময়ের বাংলায় এক বিপ্লবী উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত।

কৃষির পাশাপাশি শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নেও তিনি ছিলেন সমান সচেতন। পতিসরে তিনি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং স্থানীয় জনগণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে দাতব্য চিকিৎসালয়ের ব্যবস্থা করেন।
দরিদ্র কৃষকদের দুঃখ-বেদনা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন। দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব কেবল গ্রামীণ মানুষের উন্নতির মধ্য দিয়ে।

পতিসরের এই অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তীতে তিনি শ্রীনিকেতনে পল্লীউন্নয়নের একটি সুসংগঠিত নীতি ও বাস্তব কর্মপরিকল্পনা গড়ে তোলেন।
রবীন্দ্রনাথের এই বহুমুখী উদ্যোগ কেবল পতিসরকে এক দারিদ্র‍্যমুক্ত ও স্বনির্ভর গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলেনি; বরং গ্রামের মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ, ঐক্য ও উন্নয়নচেতনার বীজ বপন করেছিল। তাঁর সাহিত্যকীর্তির মতোই জমিদার হিসেবে এই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তাঁর কর্মজীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।

গ্রাম উন্নয়নের প্রয়াসকে আরও স্থায়ী ও বৈজ্ঞানিক রূপ দিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ও গোষ্ঠীবিদ্যা শিক্ষা নিতে পাঠান। তাদের উদ্দেশে চিঠিতে কবি লিখেছিলেন—
দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে তোমরা বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারলে তবেই তোমাদের শিক্ষা সার্থক হবে। এই চিঠি তাঁর মানবিকতা, প্রজাদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং উন্নয়নকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এক উজ্জ্বল দলিল।

রবীন্দ্রনাথের পল্লীসমাজ ধারণা ছিল স্বশাসিত, সংগঠিত ও জ্ঞানভিত্তিক গ্রামগঠনের এক আদর্শ মডেল। তাঁর মতে গ্রামের উন্নয়ন হবে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়,
গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েতব্যবস্থার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে,
আর অর্থনৈতিক ভিত্তি হবে সমবায় ব্যবস্থা।
এ ভাবনারই অসামান্য বাস্তবায়ন ঘটে পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে। আজ আমরা যখন বিশ্বায়ন, স্থানীয় সরকার উন্নয়ন, কৃষকের সংগঠিত শক্তি বা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কথা বলি, তখন বিস্মিত হতে হয় শত বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ এসব ভাবনার বাস্তব পরীক্ষণ করেছিলেন পতিসরে।

নওগাঁ, নাটোর ও বগুড়ার একটি বৃহৎ অংশজুড়ে বিস্তৃত কালীগ্রাম পরগনায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সমবায় ও শিল্পভিত্তিক এক সমন্বিত গ্রামউন্নয়ন মডেল। যা আজও উন্নয়ন চিন্তায় এক দীপ্যমান দৃষ্টান্ত।

পতিসরের মানুষ আজও তাঁকে শুধু কবি হিসেবে নয়, বরং একজন প্রজাদরদি জমিদার, একজন সংগঠক, একজন চিন্তাবিদ ও একজন সত্যিকার পথপ্রদর্শক হিসেবে স্মরণ করে।

রিফাত হোসাইন সবুজ
গণমাধ্যম কর্মী
সাধারণ সম্পাদক, জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, নওগাঁ

আরো পড়ুন