নিষিকুটুমদের সৃষ্টি খৃষ্টপূর্বে হলেও এর সঠিক সময় নিয়ে বিতর্ক আছে। রোম সাম্রাজ্যের সময়ও এই পতিতাবৃত্তি তুলে দেবার জোর প্রচেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তুু কোন লাভ হয়নি। পৃথিবীর সব দেশেই পতিতা/নিষিকুটুমদের বিচরণ রয়েছে। এরা ভিনগ্রহের কোন প্রাণী নয়, এরা মানুষ, এদের জন্ম “মা” নামক নারী জাতির গর্ভ থেকে। মাতৃগর্ভের নি:স্পাপ মেয়ে শিশুটিই আজকের জনপ্রিয় কোন পতিতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে পতিতাবৃত্তিতে ভিয়েতনামি মেয়েরা বেশী যুক্ত হয়েছিল জার্মান সৈনিকদের দ্বারা। আমাদের দেশে প্রায় ১৩টির মতো নিষিদ্ধপল্লী রয়েছে। বৃটিশ শাসনামলে রাজবাড়ী, দৌলতদিয়াঘাটে বৃটিশ সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্য পতিতাপল্লী গড়ে উঠলেও, পরবর্তিতে ১৯৮৬ সালে বর্তমানের জায়গায় নিষিদ্ধপল্লীটি স্থান্তারিত হয়।
পতিতাপল্লী মানেই যৌনকর্মীদের যৌনপেশার নির্ধারিত একটি স্থান। এখানে অনেক নারী পতিতা থাকবে, থাকবে এদের একজন সরদার্নি। সরদার্নি প্রথা বহু প্রাচীন, বহু পতিতাদের একজন নেতা বা সরদার্নি থাকবে, সবাই তাকে মেনে চলবে, তার ইশারার বাহিরে কেউ কিছু বলতে/করতে পারবে না। সরদার্নির একদল সন্ত্রাসী, পেটোয়া বাহিনী থাকবে, এরা সরদার্নির নির্দেশে পতিতাপল্লী নিয়ন্ত্রন করবে। এটাই পল্লীর নিয়ম।
সরদার্নির নির্যাতনে নির্যাতিত হয়ে, একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে নিষিদ্ধপল্লীতে শুরু হয় মাসী প্রথা। এই মাসীকে বাড়িওয়ালীও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত একটি নিষিদ্ধপল্লীতে ১০০-৫০০ বাড়ি থাকে, সেই বাড়িগুলোতে ৫-১০টিরও অধিক ঘর থাকে। ১টি ঘরে ১-২টি মেয়ে থাকলে, একজন মাসীর নিয়ন্ত্রণে থাকে ১০-৩০ জন পতিতা। জমির মালিক পুরুষ, তিনি সমাজের একজন নামী ব্যক্তি, তিনি পতিতাদের নাম মুখে নেন না, তিনি তার জমিতে বাড়ি বানিয়ে দিয়ে তাতে বাড়িওয়ালী/মাসীর নেতৃত্বে পতিতা রেখে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করেন। একেই বলে,খাটি উপার্জনক্ষম পুরুষ। আমার সাদা কাপড়ের আড়ালে হারামের ব্যবসা করি, পতিতার ঘাঁমের গন্ধে উপার্জিত অর্থে জীবন গড়ি।
বিশ্বের বিভিন্ন এনজিও পতিতাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করলে, বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালী, মাসী, সরদার্নি কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন গ্রুপের নেতাদের দ্বারা নির্যাতিত যৌনকর্মীরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য বাবু রাখার ব্যবস্থা শুরু করে। বাবু হচ্ছে একজন যৌনকর্মীর স্থায়ী বা পার্মানেন্ট খদ্দের/কাষ্টমার। এদেরকে অনেকই স্বামী হিসেবেও মানে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কারনে, কোন দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা না করে, তাদের জন্য সঠিক পন্থায় পূনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে নিষিদ্ধপল্লী বা পতিতাপল্লী ভেঙ্গে ফেলাতে, পতিতাপল্লীর সেইসব মাসীরাই আধুনিক সংস্করণে মম, খালা, মডেল নামে শহরের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তার কিছু প্রতিফলন আমরা দেখতেও পাচ্ছি।
আপনি/আমি ইচ্ছে করলেই যৌনপেশা উচ্ছ্বেদ করতে পারব না, কিন্তুু নিজের মন থেকে আমরা যদি প্রতিজ্ঞা করি, আমরা কোন নারীকে নির্যাতন করে, ব্লাকমেইল করে, পাচার করে, ধর্ষণ করে বিক্রি করে নিষিদ্ধপল্লীর অন্ধকার জগতে ঠেলে দিব না, তবেই তাদের সংখ্যা দিনকে দিন কমতে থাকবে। নতুবা আপনার স্বপ্নের দরজায় কড়া নেড়ে পুলিশ বলবে: দরজা খুলুন, আপনার বাড়িটি সার্চ করতে এসেছি। সাবধান!!!
আমি শিউলিকে সাতে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছি, অতি সুরু গলিপথ, অজস্র নর-নারীর গাদাগাদী অতিক্রম করে হাজির হলাম এক বাড়ীওয়ালীর ঘরের সামনে। ঘরের দরজার বাম-পাশের একটি জিনিস আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করল। তিনটি বাঁশের সংযুক্ত মাথায় স্থাপিত কাঠের পাটাতনের উপর বসানো রয়েছে একটি প্লাসটিকের জগ, তার উপর-নিচে ছোট্ট ছিদ্রযুক্ত বালিভর্তি মাটির কলসী, তার উপর বসানো রয়েছে একই ধরনের অন্য আর একটি পানি ভর্তি মাটির কলসী। এইটি এক ধরনের পানি পরিষ্কাকরণ প্রক্রিয়ার দেশীয় প্রযুক্তি। জিনিসটি দেখে বেশ মজা পেলাম এবং এক গ্লাস পানি পান করতে বাধ্য হলাম।
এরই মধ্যে শিউলি আমাকে তার খালাত ভাই পরিচয় দিতে দিতে, বিভিন্ন গলি পেড়িয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি। বাড়ীওয়ালী খালার সাথে শিউলি আমাকে তার খালাত ভাই হিসেবে পরিচিত করে দেবার পর, বাড়ীওয়ালী খালা আমাকে বিভিন্নভাবে কাজের সহযোগিতা করবার ইচ্ছাপোষণ করলেন। এরমধ্যে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলো একই ধরনের শার্ট পরিহিত দুজন ব্যক্তি, তারা আমার টিকেট কাটা হয়েছে কিনা প্রশ্ন করতেই শিউলি উচ্চস্বরে বলে উঠল:
কিরে..তোরা দেহিস না? সে কার সাথে আছে। সে আমার খালাত ভাই, মুখ চিনে রাখ, পরে কখনও আইলে তারে টিকেটের কথা জিগাবি না। আচ্ছা ঠিক আছে বলে লোক দুইটি অন্য দিকে চলে গেল। তখন আমার পেটের মধ্যে চোঁ চোঁ করছে খাদ্য গ্রহণের জন্য কারণ তখন সময় দুপুর-বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে চলছে। আমি খালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, এর-ওর ঘর পেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
এরই মধ্যে কানে আযানের শব্দ ভেসে আসলো। আযান শুনতে শুনতে চোখে পড়ল!নিষিদ্ধপল্লীর সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়ানো প্রায় অধিকাংশ মেয়েরাই একটি ছোট্ট পাত্রে পানি নিয়ে নিজের দাঁড়ানো জায়গায় পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে নতুন খদ্দের প্রাপ্তির শুভ চিন্তায়। তারা মনে করে, সন্ধ্যার এই লগ্নে নিজের দাঁড়িয়ে থাকার স্থানকে পানি ছিটিয়ে পবিত্র করলে খদ্দের বেশী পাওয়া যায়।
পেটে ক্ষুধা থাকলে নিয়মের ফাঁকড়াও বাড়ে। দোকানী দোকানে পানি ছিটিয়ে কিংবা আঁগরবাতি অথবা ধুপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যায় অধিক বিক্রির জন্য শুভসূচনা করে। যত বিক্রি হবে তত লাভ। এখানে নারী তার দেহকে পণ্য বানিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে বিক্রির দোকান খুলেছে, যত খদ্দের পাবে তত তাদের হাতে অর্থ আসবে, বিনিময়ে তাদের রক্ত-মাংসের তুলতুলে দেহটি খদ্দেরের নখের আঁচড়ে তত বেশী ক্ষত-বিক্ষত হবে। কেই যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, কেউ কেউ যৌনাজ্ঞ রক্তাত্ব হবার দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে, কেউ কেউ ৮-১০জন পুরুষ খদ্দের বুকে নিয়ে নির্ধিদায় হেঁটে যাবে কোমর দুলিয়ে।
আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে আমি রিক্সায় উঠে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিব, এমন সময় শিউলি:
বন্ধু, তোমার ব্যবহার আমার খুব ভালো লাগল।
ধন্যবাদ বন্ধু তোমাকেও আমার ভাল লেগেছে।
তুমি কি ডাব খাবে?
ডাব খাবার প্রস্তাব পেয়ে আমি ভাবছি!!!
ভেবনা….খুবই কচি….হা হা হা
শিউলির হাসিতে আমিও হা হা হা করে হেসে দিলাম। বললাম, খেতে পারি, তবে টাকা আমি দেব।
কেন? আমার কি টাকা নেই?
না…ঠিক তা নয়।
আমি বেশ্যা বলে কি তুমি আমাকে ঘৃণা করছো?
না না, তোমাদের ঘৃণা করলে ত আমি তোমাদের কাছে আসতাম না কিংবা তোমাদের নিয়ে কোন কাজও করতাম না।
তাহলে?
না…বলছিলাম…আমি তো চাকরি করি, টাকাটা আমিই দেই।
কেন? আমিও তো ব্যবসা করি, আমার শরীর বিক্রির টাকা দিয়ে ডাব খেতে তোমার ঘৃণা করছে?
ছি: ছি: কি বলো! আমি তেমনটি ভাবছি না। আমি কিছু বলার পূর্বেই আবারও সে বলল
তোমরা আমাদের চু: পারো, আমাদের চু: তোমাদের খারাপ লাগেনা, আমাদের সঙ্গে জনসম্মুখে কথা বলতে লজ্জা লাগে? আমাদের নাম “বেশ্যা” মুখে নিতে লজ্জা লাগে তোমাদের, কিন্তু তোমরা তোমাদের নিজের বউ’রে যখন বেশ্যা বলে গালি দাও, তখন কি তোমাদের একটুও খারাপ লাগে না?
আমি লজ্জা নিয়ে বললাম: তোমার কি খিস্তি-খেউর শেষ হয়েছে?
শিউলি: না…এখনও শেষ হয়নি।
আচ্ছা ঠিক আছে, চল, তোমার টাকায় ডাব খেতে খেতে তোমার মুখের খিস্তি-খেউর শুনি।
আমার সম্মতি পেয়ে শিউলি রাস্তায় ডাব নিয়ে বসে থাকা লোকটিকে বলল: ঐ মিয়া… আমার বন্ধুরে একটা আনকোড়া কচি ডাব দাও ত
আমি হেসে বললাম: তুমি ডাবের মধ্যে আনকেড়াা পাইলা কই?
খিস্তি দিয়ে শিউলি বলল: তোমরা শালা, ঐটাই তো বেশী পছন্দ কর, মুখে লজ্জা চো….ক্যা?
না না, লজ্জা করিনা, লজ্জা থাকলে কি তোমাদের নিয়ে কাজ করতে আসি। তাহলে আজকে যাই বন্ধু। আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে, রাত হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিন কথা হবে। আমি রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আবারও যাব আগামী সপ্তাহে। (চলবে)

