নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার কোলা ইউনিয়নের ভান্ডারপুর—নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না, কিন্তু এই স্থানটি নীরবে সারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি কেবল একটি গ্রাম নয়, বরং ভৌগোলিক সুবিধা, সমৃদ্ধ কৃষি এবং সুপ্ত শিল্প সম্ভাবনার কারণে এটি দ্রুতই বদলগাছীর অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু বা ‘গেটওয়ে’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
ভান্ডারপুর: যেখানে শুরু হয় দেশের শীতকালীন সবজির জোগান
পাইকারি কৃষিপণ্যের হাব:
ভান্ডারপুরের প্রধান পরিচিতি এর পাইকারি সবজি বাজার। কোলা ইউনিয়ন থেকে শুরু করে আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উৎপাদিত টাটকা ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো সহ অন্যান্য শীতকালীন সবজি এই ভান্ডারপুর হাট থেকেই সারা দেশের বড় বড় বাজারে সরবরাহ হয়।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই বাজারকে আরও আধুনিক করা প্রয়োজন। কৃষকদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা এবং পণ্য সংরক্ষণের জন্য উন্নত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা তৈরি করা হলে ভান্ডারপুর দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় কৃষি-বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হবে।
ভান্ডারপুর ব্র্যান্ডিং’: ভান্ডারপুরের সবজিকে একটি বিশেষ মানদণ্ড দিয়ে ব্র্যান্ডিং করলে জাতীয় বাজারে এর কদর আরও বাড়বে।
স্থানীয় ক্ষুদ্র শিল্পে ভান্ডারপুরের ভূমিকা:
ভান্ডারপুর সংলগ্ন কোলা বাজারে রয়েছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প , যেমন সুতা কারখানা, পাপোষ কারখানা এবং ঐতিহ্যবাহী বেকারি কারখানা।
বেকারি শিল্পের বিপ্লব করার সুযোগ রয়েছে।এই বেকারি কারখানাগুলো আধুনিকায়ন ও মান নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলে এদের উৎপাদিত পাউরুটি, বিস্কুট ও বেকারি আইটেমগুলো দেশজুড়ে সমাদর পেতে পারে। ভান্ডারপুরকে কেন্দ্র করে একটি ‘মানসম্মত বেকারি ক্লাস্টার জোন” তৈরি করা সম্ভব, যা স্থানীয় যুবকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান ও রেল সংযোগের গুরুত্ব রয়েছে ভান্ডারপুরের।
একাটি ‘ত্রিভুজীয়’ বাণিজ্যিক কেন্দ্র:
ভান্ডারপুরের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। এটি নওগাঁ জেলা সদর, জয়পুরহাট এবং আক্কেলপুর দিয়ে বগুড়া যাবার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত।
এই অবস্থান ভান্ডারপুরকে একটি লজিস্টিক হাব হওয়ার সুবিধা দেয়। সড়কপথে তিন জেলার পণ্য আদান-প্রদানে ভান্ডারপুর ‘স্টপিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করতে পারে।
বদলগাছীর উন্নয়নে ভান্ডারপুরের অবদান হবে কেন্দ্রীয়:
এই কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে এখানে একটি আধুনিক ট্রাক টার্মিনাল বা লজিস্টিক পার্ক তৈরি করা সম্ভব।
রেললাইনের স্বপ্ন:
যদি আক্কেলপুর থেকে ট্রেন লাইনটি বদলগাছী হয়ে আমের রাজধানী সাপাহারের সাথে যুক্ত হয়, তবে ভান্ডারপুর হবে এই রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন।
স্থলবন্দর ও বাণিজ্যের লাইফলাইন:
সাপাহারের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রস্তাবিত স্থলবন্দর এর সঙ্গে এই রেললাইন যুক্ত হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ সুগম হবে।
আম, চাল, সবজি সহ সব ধরনের পণ্য স্বল্প খরচে ও দ্রুত গতিতে সীমান্তের দিকে পরিবহনের কেন্দ্র হবে ভান্ডারপুর। এটি বদলগাছী উপজেলাকে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
পর্যটন শিল্পে ভান্ডারপুর ও বদলগাছীর নতুন সম্ভাবনা
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের প্রবেশদ্বার:
ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) বদলগাছী উপজেলাতেই অবস্থিত। পর্যটন বিকাশে ভান্ডারপুরের অবদান রাখতে পারে এটা অনস্বীকার্য।
পর্যটন হাব: পাহাড়পুরের কাছাকাছি হওয়ায় ভান্ডারপুরকে পর্যটকদের জন্য উন্নত মানের ‘বিশ্রাম ও গেটওয়ে পয়েন্ট’ হিসেবে তৈরি করা যায়। এখানে মানসম্পন্ন আবাসন, রেস্টুরেন্ট এবং স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান তৈরি হলে পর্যটকরা স্থানীয় অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখবে।
পাহাড়পুরকে কেন্দ্র করে মহাদেবপুর ও পত্নীতলার ধানের রাজ্য, সাপাহারের আমের রাজ্য, ঐতিহাসিক দিবর দিঘি এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নিয়ে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন সার্কিট তৈরি করতে পারে বদলগাছী ও ভান্ডারপুর।
এগ্রো ট্যুরিজম ও বাণিজ্যের সংযোগ:
মহাদেবপুর ও পত্নীতলার বিশাল ধানের রাজ্যকে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
এগ্রো ট্যুরিজম: ধান কাটা, রোপণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (চালকল) দেখার সুযোগ দিয়ে একটি নতুন ধরনের কৃষি-পর্যটন (অমৎড়-ঞড়ঁৎরংস) শুরু করা যায়। এতে ভান্ডারপুর কে কেন্দ্র করে পর্যটকরা গ্রামীণ জীবনের স্বাদ পাবে।
বাণিজ্যিক গুরুত্ব: ধানের বাই-প্রোডাক্ট শিল্প (রাইস ব্র্যান অয়েল, তুষ থেকে বিদ্যুৎ) ভান্ডারপুরে স্থাপন করে এই কৃষিজমির অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আরও বাড়ানো যেতে পারে।
কৃষি বাই-প্রোডাক্ট শিল্প স্থাপনের জন্য ভান্ডারপুর একটি আদর্শ স্থান।
আমের উপজাত শিল্প করতে আমের সিজনে সাপাহার থেকে অতিরিক্ত আম এনে ভান্ডারপুরে আমসত্ত্ব, আচার, জুস, জেলি তৈরির কারখানা স্থাপন করা সম্ভব।
ধানের প্রাচুর্যের কারণে এখানে রাইস ব্র্যান অয়েল বা তুষভিত্তিক বিদ্যুৎ তৈরির প্ল্যান্ট স্থাপন করলে বদলগাছী ও ভান্ডারপুর স্থানীয় শিল্পায়নে নেতৃত্ব দেবে।
ভান্ডারপুর মূলত তার শক্তিশালী কৃষি ভিত্তি, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এবং পাহাড়পুরের নৈকট্যের মাধ্যমে বদলগাছী উপজেলার উন্নয়নে ‘মূল চালিকাশক্তি’ হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত। সঠিক সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলটি দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে পারে।
তাহির ইবনে মোহাম্মদ নয়ন: লেখক ও প্রকাশক, বদলগাছী, নওগাঁ

