ভোরের আলো ফোটার আগেই নওগাঁ শহর যেন জেগে ওঠে ক্লান্তির আরেক অধ্যায় শুরু করতে। প্রথম সূর্যের রশ্মি যখন হালকা কুয়াশা ভেদ করে নেমে আসে, তখনই শুরু হয় শহরের রাস্তায় স্থবিরতার খেলা। ছোট্ট শহর, অথচ জীবনের চলমান ছন্দ যেন প্রতিদিনই আটকে যায় চারদিকে থেমে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ লাইন আর অসহায় অপেক্ষার গহ্বরে।
একসময় নওগাঁর সকাল ছিল মধুর, শান্ত, নরম। বাজারপাড়ায় কলরব ছিল ছন্দময়। এখন সেই জায়গা দখলে নিয়েছে তীব্র হর্ণের চিৎকার, থেমে থাকা রিকশার সারি আর দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের অস্থিরতা। শহর যেন আর আগের মতো নিজের মতো নেই—চাপা কষ্টের শহর হয়ে উঠেছে।
নওগাঁর আয়তন অল্প। কিন্তু এর ভেতরে ঢুকে পড়েছে হাজার হাজার যানবাহনের ভিড় বৈধ ও অবৈধ সব মিলিয়ে লাখো চাকার প্রতিদিনের লড়াই। যে শহর সহজে শ্বাস নেয়ার কথা, তার গলায় এখন আঁট বেঁধে আছে অব্যবস্থাপনার দড়ি। ইজিবাইকের জোয়ার যেন শহরটিকে গ্রাস করেছে। অনুমোদিত-অননুমোদিত মিলে সংখ্যার হিসাব এতটাই বিচিত্র যে তা শহরের ধারণক্ষমতাকেই অস্বীকার করে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মোটরসাইকেল, সিএনজি, রিকশা, ভ্যান, ব্যক্তিগত গাড়ি—যেন সবাই একই সময় একই রাস্তায় নামতে বাধ্য। এক সময় যে রাস্তায় হেঁটে যেতে দু’মিনিট লাগত, এখন সেই পথ পেরোতে সময় লাগে এক অনন্ত প্রতীক্ষা।
শহরের ফুটপাতগুলো আজ নেই বললেই চলে। দোকানের সামনে সাজানো মালপত্র, তার সামনে আবার ভ্রাম্যমাণ দোকানি হাঁটার পথটুকু যেন একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। ফলাফল মানুষ হাঁটে রাস্তায়, ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে গাড়ির ধাক্কা, ধুলো আর শ্বাসরুদ্ধ সময় তাদের ঘিরে ধরে। হাঁটতে থাকা মানুষদের চোখে অসহায়তা স্পষ্ট। তারা জানে, এই শহরে নিরাপদ পথ নেই, আছে শুধু যানজটের সাথে প্রতিদিনের যুদ্ধ।
শহরের মোড়গুলো যেন এখন অস্থায়ী স্ট্যান্ডে পরিণত। নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই যেখানে একটু খালি, সেখানেই থেমে যায় ইজিবাইক, রিকশা বা ভ্যান। মোড়ের স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে যায়, গলিতে আটকে যায় তীব্র উত্তাপ, আর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে অকারণ অপেক্ষায়। চালকেরা জানে, তাদের থামা সমস্যার কারণ; তবুও তারা বলে থামব কোথায়? জায়গা তো নেই! এ এক অদ্ভুত চক্র যেখানে সমস্যায় সবাই জীবনের প্রয়োজনে জড়িয়ে পড়ে।
বাজার এলাকা যেন প্রতিদিনই উত্তপ্ত ধুকধুক করা হৃদপিণ্ড। এখানে রিকশা, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক সব একসাথে। দাঁড়ানো, থামা, চিৎকার, মালামাল ওঠানামা সব মিলে তৈরি হয় এক বিশ্রী বিশৃঙ্খলা। দোকানদারেরা নিজের দোকানের সামনে মাল রাখে, আর সামনে দাঁড় করানো হয় ছোট যানবাহন। ফলে ক্রেতা, পথচারী সবাই যেন আটকে থাকা এক স্রোতের যাত্রী। কোনো গোলচত্বর নেই, নেই খোলা মোড়—যেখানে যানবাহনগুলো শৃঙ্খলায় চলতে পারে। শহর যেন একটি টানেল, যার মুখ সবসময়ই বন্ধ।
শহরের নিয়ম আছে নির্দিষ্ট সময়ে ভারি যানবাহন ঢুকবে না। কিন্তু নিয়মও কখনো কখনো যানজটের ভিড়ে হারিয়ে যায়। এই নিয়মভঙ্গের কিছু অংশ দায়িত্বহীনতা, কিছু অংশ প্রয়োজন, এবং কিছু অংশ অব্যবস্থাপনার ফল যার মূল্য দেয় প্রতিদিন সাধারণ মানুষ। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সও অনেক সময় আটকে থাকে যানজটে। জরুরি সেবা থেমে যায়, জীবন থমকে যায়।
দিকে দিকে আলোচনায় এখন একটি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা। শহরের প্রধান সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ একটি নতুন আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছে। প্রশস্ত রাস্তা, ফুটপাত, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, আন্ডারপাস-ওভারপাস, বাসস্টপ—আধুনিক বৈশিষ্ট্যে ভরা একটি নতুন শহরের স্বপ্ন কেউ কেউ দেখতে শুরু করেছেন।
১৬ কিলোমিটারের বেশি সড়ক প্রশস্ত হয়ে গেলে নওগাঁ হয়তো একদিন তার পুরোনো শ্বাস ফিরে পাবে হয়তো আবার সকালের হাওয়ায় থাকবে আরাম, বিকেলের রোদে ফুটপাত হয়ে উঠবে হাঁটার পথ, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলবে সবাই।
আজকের নওগাঁ দাঁড়িয়ে আছে দুই সময়ের সন্ধিক্ষণে। একদিকে যানজট আর অচলাবস্থার দমবন্ধ করা বাস্তবতা, অন্যদিকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। শহরের মানুষ প্রতিদিন আশায় থাকে—এই চাপ, এই স্থবিরতা, এই অগোছালো চিত্র একদিন বদলে যাবে। হয়তো একদিন রাস্তায় বের হলেই আর প্রথম দর্শন হবে না দীর্ঘ যানজট। হয়তো একদিন নওগাঁ আবার ছোট শহরের মতো ছোট সুখে ভরবে। সেই দিনের জন্যই নওগাঁবাসীর অপেক্ষা প্রতিটি ভোর, প্রতিটি পথ, প্রতিটি শ্বাসে।
লেখক- রিফাত হোসাইন সবুজ, গণমাধ্যম কর্মী, সাধারণ সম্পাদক জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, নওগাঁ

