মানবজাতির আদি ইতিহাস থেকে দেখা যায়—যখনই মানুষ আল্লাহর নির্দেশনা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তখনই সমাজে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, মূর্তিপূজা, জ্যোতিষ, অশুভ ধারণা, দেবতার সন্তুষ্টির নামে অমানবিক রীতি এবং বিভিন্ন ভিত্তিহীন বিশ্বাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
কুসংস্কার হলো এমন বিশ্বাস, ধারণা বা আচরণ—যার কোনো যুক্তি, প্রমাণ বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই; তবুও সমাজে তা প্রচলিত। এক কথায়, কুসংস্কার হলো ভিত্তিহীন বিশ্বাস, যার পেছনে না থাকে যুক্তি, না থাকে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। মানুষের মনগড়া ধারণা, কাল্পনিক চিন্তাভাবনা কিংবা লোকমুখে প্রচলিত গল্প—এসব থেকেই সাধারণত এমন বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এসব রীতি-নীতি বংশপরম্পরায় চলে আসে, আর সমাজের মানুষ প্রশ্ন না করেই তা অনুসরণ করতে থাকে।
মানব ইতিহাসের সূচনা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কুসংস্কার মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেসব নবী ও রাসূলকে মানবজাতির পথপ্রদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছেন—তাদের প্রত্যেকের উম্মতের মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। নবী-রাসূলদের দাওয়াতি কাজের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে এসব ভ্রান্ত ধারণা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করা।
কারণ, মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন— “আমি জিন্ন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমারই ইবাদত করার জন্য।” (সূরা জারিয়াত: আয়াত: ৫৬)
সুতরাং, নবী-রাসূলগণ তাদের জাতিকে তাওহিদের দিকে ডেকেছেন—এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পাশাপাশি সতর্ক করেছেন যেন তাদের ইবাদত ও জীবনধারা কোনো ধরনের কুসংস্কার, ভিত্তিহীন বিশ্বাস বা আল্লাহপ্রদত্ত কিতাবসম্মত নয় এমন রীতিনীতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়।
পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন নবীর যুগে সংঘটিত এসব কুসংস্কারকে তুলে ধরে মানুষকে সত্য ও যুক্তির পথে আহ্বান জানিয়েছে। পূর্ববর্তী নবীগণ সালাম তাদের সমাজে এ অন্ধবিশ্বাস ভাঙতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। নীচে নবীভেদে সেসব কুসংস্কারের বিবরণ দেওয়া হলো।
১. হযরত নূহ (আ.) এর যুগের কুসংস্কার:
হযরত নূহ (আ.) এর কওম দীর্ঘ সময় মূর্তিপূজায় নিমগ্ন ছিল। সমাজে প্রচলিত হয়েছিল—কোনো নেককার মানুষ মারা গেলে তার স্মৃতিতে মূর্তি গড়ে সেটি পূজা করলে বরকত নেমে আসে, বিপদ দূর হয় এবং রিজিক বৃদ্ধি পায়। এভাবেই ওয়াদ্দ, সুয়াআ, ইয়াগূস, ইয়াঊক ও নাসর নামের মূর্তিগুলো গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল, এই মূর্তিগুলোই সুখ-দুঃখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। মূর্তির নামে মানত করলে সন্তান জন্মায়।
পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা তোমাদের উপাস্যদের কখনো ছাড়বে না—যেমন ওয়াদ্দ, সুয়াআ, ইয়াগূস, ইয়াঊক ও নাসর।” (সূরা নূহ: আয়াত: ২৩)
তাফসীর: (ইবন কাসীর থেকে সারাংশ)
এ নামগুলো ছিল আদিতে নেককার মানুষের নাম।
পরে শয়তান মানুষকে বুঝায়—“তাদের প্রতিকৃতি বানাও, তোমাদের ইবাদত বাড়বে।”
এ বিশ্বাস সমাজকে শির্কের গভীর তলানিতে ঠেলে দেয়, আর নবী নূহ (আ.) তাদের এই কুসংস্কার থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রায় এক সহস্র বছর দাওয়াত দিলেও তারা সত্য গ্রহণ করেনি।
এ ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম বৃহত্তম কুসংস্কার।
বর্তমান সমাজে লক্ষ্য করলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে বহু কুসংস্কার এখনো আমাদের মাঝে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে আছে। যুগের পর যুগ ধরে যে ভুল ধারাবাহিকতা চলে আসছে, তা আজও বিভিন্ন রূপে প্রতিফলিত হয়।
আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো—যখন আল্লাহর কোনো নেক বান্দা ইন্তেকাল করেন, তখন তাকে দাফনের পর তার কবরকে মাজারে পরিণত করা হয়। এরপর বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট বা অসুস্থতার সময় অনেকে সেই মাজারে গিয়ে দোয়া ও সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাদের বিশ্বাস থাকে, ওই ব্যক্তির কারণে আল্লাহ তাদের সমস্যার সমাধান করবেন।
কিন্তু আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না যে এ ধরনের বিশ্বাস ও কাজ কত বড় গুনাহ। ওলামায়ে কিরাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন—মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া বা তার কাছে প্রার্থনা করা শিরক-এর অন্তর্ভুক্ত। আর শিরক এমন এক অপরাধ—যার পরিণতি নিশ্চিতভাবে জাহান্নাম, যদি কেউ তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে।
অতএব, একজন মুসলমানের উচিত হলো—আল্লাহ যখনই কোনো পরীক্ষা নেন, তখন নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে কেবল তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা, এবং মাজার বা কবর থেকে সাহায্য চাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজেই আমাদেরকে দোয়া ও সাহায্য প্রার্থনার সঠিক পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন: “তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা করো।” — সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪৫
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিরকমুক্ত সঠিক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক:আহমাদ হিজবুল্লাহ মাদানী
সিনিয়র আরবি শিক্ষক, এভাররোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, পল্লবী,ঢাকা।
অনার্স (কুল্লিয়াতুশ শরীয়াহ), ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ: ইসলামিক ইউনিভার্সিটি,মদিনা।

