চন্দ্রদাহ পর্ব- ৫

জিল্লু র রহমান শুভ্র

by sondeshbd.com
43 views

পঁচিশে মার্চ!
মায়াময় বিষণ্নতার গোধূলি সন্ধ্যারাতের দরজায় পা ছড়িয়ে বসেছিল, হঠাৎ স্বৈরাচারী
অন্ধকারের দাবড়ানি খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পা ফসকে পড়ে গেল অতল গহ্বরে; আর
তখন থেকেই কালরাত্রি’র সূচনা।
সাবিত্রী’র মন বসছিল না কিছুতেই। অস্বস্তি খচখচ করছিল মনের ভেতর। ঘাড়
টনটন করছিল রাসেলের চিন্তায়। কারণ, সে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকিতে। যদিও
সে কয়েক দিন থেকেই এড়িয়ে চলছিল তাকে। তবে এটি সত্য, তার হৃদয়ে ভালোবাসায়
মোড়ানো একটি ‘নীলকান্ত মণি’ ছিল যার নাম ‘রাসেল’।
বিবিসি বাংলা সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের হালহকিকত শোনার পর থেকেই তার মনে
দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আনাগোনা করছিল। তার এ-ও মনে হচ্ছিল কোনো একস্থানে ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুরা তাদের যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র শান দি”েছ এবং গভীর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
করছে। তার আধিভৌতিক আলামত সে টের পাচ্ছিল। কিছু কুকুর ঘরের বাইরে সকরুণ
সুরে ডাকছিল! উদ্ভট পাখির ঝাঁক অন্ধকার আকাশে উড়ছিল চক্রাকারে! পেনসিলের
সিসারং বেড়াল যেন মনিবকে হারিয়ে পেছনের বাগানে মিউমিউ করছিল! ভুতুড়ে ধ্বনির
অনুরণন আসছিল অর্জুন গাছের উপরের দিক থেকে! তাছাড়া, বিস্ময়ের খোঁয়াড় ডিঙিয়ে
সুদূর থেকে ভেসে আসছিল সাতকাহন বেদনা সঙ্গে নিয়ে তল্লাবাঁশের বাঁশির সুর! সে এই
রহস্যজনক ঘটনাগুলোর গভীরে যাওয়ার এবং এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করছিল। এভাবেই
উদ্ভট, খাপছাড়া মানসিক সমস্যাগুলো অক্টোপাশের মতো তাকে জড়িয়ে ধরছিল। ফলে,
তার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল অসহ্য যন্ত্রণার করাতে। Skinny chemise-এর সাথে arette pantsপরিহিত রাত্রি দুর্গোমণ্ডার সঙ্গে
গ্লাসভর্তি fool পিতলের থালাতে নিয়ে তার কাছে এল এবং গদগদ ভঙ্গিতে বলল,
“দিদি, তোমার জন্য।”
সাবিত্রী মুখ কালো করে বসেছিল একটা হাতলবিহীন চেয়ারে। গভীর চিন্তামগ্ন।
গ্লাসের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বলল সে, “খাব না, যা!”
“খাবে না কেন? খুব টেস্ট হয়েছে। আমি বানিয়েছি। তুমি পছন্দ করো তাই। foolনা খেলে দুর্গোমণ্ডা খাও। খুব টেস্টি।” রাত্রি তাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে অতি উৎসাহী
হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে তার দিদির আরো কাছাকাছি চলে এল যাতে সে থালাটি সহজেই
ধরতে পারে বা নিতে পারে।
সাবিত্রী’র ক্রোধের পারদ হঠাৎ উপরের দিকে ধাবিত হলো। অপরিণামদর্শীর মতো
রাত্রি’র হাতের থালাটির দিকে বাড়ি দিল। সঙ্গে সঙ্গে এটি মেঝেয় পড়ে ঝনঝন শব্দে
ঘরের ঢিপেশোকা আবহ বিরক্তিকর করে তুলল। আর কাচের গ্লাসটি ভেঙে টুকরো
টুকরো হয়ে ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়ল। দুর্গোমণ্ডাও কম কীসে! সে-ও ভ্যা করে উঠল। আর
সাবিত্রী গলা চড়াল, “গেট আউট! গেট আউট অফ হিয়ার!”
রাত্রি হতভম্ব। হতভম্বের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘরের কান ফাটিয়ে কাঁদতে
লাগল সে।
বাবা-মা সাবিত্রী’র মতো অপরিণামদর্শী ছিলেন কিংবা ছিলেন না তারচে’ বড় কথা তারা
পাশের ঘরে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলছিলেন। তাদের বড় মেয়ে দ্রুত বেড়ে
উঠছিল। পড়াশোনা শেষ করার সাথে সাথে তাকে একজন সৎ, শিক্ষিত এবং ব্রাহ্মণ
পরিবারের ছেলের সাথে বিবাহ দিতে চাইছিলেন তারা। হিন্দু বিবাহে প্রচুর খরচ, এবং
কীভাবে এই ব্যয়ভার সঙ্কুলান করা যায় তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতির বিষয়ে প্রাথমিক
আলোচনা। বিত্তের ছড়াছড়ি ছিল না বিধায় বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মি. চ্যাটার্জী
খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন, তার মিসেস আলমিরা খুলে একসেট গয়না তার সামনে
রেখে দিয়ে বললেন, “রাজকন্যার মতো হিরে-জহরতে মুড়িয়ে মেয়েকে তো বিয়ে দিতে
পারব না, তবে এই সেটটা তোমার বড় মেয়ের জন্য। এটি আমার মায়ের দেওয়া।
আর তুমি যে গয়না দিয়েছ তা রাত্রি’র জন্য তোলা থাকবে।” হঠাৎ ঝনঝনানি শব্দে
তাদের মনোযোগ এলোমেলো হয়ে গেল। গয়নার বাক্স যেভাবে খোলা ছিল সেভাবে খোলা
রেখে তারা ছুটে এলেন পাশের ঘর থেকে, এবং সমস্বরে বলে উঠলেন, “আরে! আরে!
হয়েছেটা কী?”
রাত্রি’র কান্না তখনো থামেনি।
সাবিত্রী উত্তেজিত, “তাকে বললাম ভড়ড়ষ খাব না! দুর্গোমণ্ডাও না! শুনছিল না। চাপ
দি”িছল বারবার!”
“এজন্য গ্লাস ভাঙতে পারো?” অভিযোগের শর নিক্ষেপ করে কর্কশ স্বরে মা বললেন,
“এটি তোমার এক ধরনের ছেলেমানুষি, তাই মনে করি।”
“মা, এটা ছেলেমানুষি না! আমার ভালো লাগছিল না!” সে-ও কর্কশ স্বরে বলল।
এরপর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে, “যদি রাত্রিকে নষ্ট করতে না চাও, dont baby

her! বাবা সাবিত্রী’র কাছে এলেন, তাকে স্নেহ করলেন, এবং বললেন, “হাজার হোক,
রাত্রি তোমার ছোট। তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারো না।”
“দুঃখিত! আমি ভুল করেছি।” নরম হয়ে এল সে, এবং তারপর রাত্রিকে জড়িয়ে
ধরে শব্দ করে তার কপালে চুমু খেল—উম্মা! দিদি’র আদর পেয়ে রাত্রি তার কান্না ধূসর
মরুভূমির শব্দহীন বিলাপের কাছে জিম্মি রাখল।
এই দৃশ্যটি নিত্যানন্দ চ্যাটার্জীকে যেমন অভিভূত করল তেমনি সাবিত্রীকে কিছু
একটা (তার মনে যে সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল) জিজ্ঞাসা করার সাহস উসকে দিল, “তুমি কী
ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? বিনা দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।”
সাবিত্রী তার পার্স ফট করে বন্ধ করল, এবং বলল, “হ্যাঁ বাবা!”
“কী সমস্যা যা তুমি আমাকে বলতে পারছ না?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
“মনে হচ্ছে, শত্রুরা যে-কোনো সময় আমাদের আক্রমণ করতে পারে!” বলল সে,
ফ্যাকাশে মুখে।
“সম্ভাব্য শত্রু কারা?” বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।
“পাকিস্তান সেনারা,” বলল সে।
“যতটা বলা হচ্ছে ততটা সহজ না। জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করবে। তাছাড়া একটি
বড়দেশ আমাদের প্রতিবেশী। যদি পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করে তবে তারা
ঐতিহাসিক ভুল করবে। তুমি জানো বাঙালিরা কাপুরুষ নয়। এদেশ মাস্টারদা সূর্যসেনের
দেশ, এদেশ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দেশ। ব্রিটিশরা পারেনি, পাকিস্তানিরাও দাবিয়ে
রাখতে পারবে না। ইঁদুরের মতো কেউ গর্তে বসে থাকবে না। তাদের যা যা আছে
তাই নিয়ে বেরিয়ে আসবে,” কথাগুলো বললেন তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে। এবার
মেয়েকে নসিহত করতেও ভুললেন না, “বিছানায় যাও, ঘুমানোর চেষ্টা করো। সব কিছু
ঠিক হয়ে আসবে।”
“ঘুম না আসলে কী করব? ধানের বস্তার মতো পড়ে থাকব?” বলল সে, রুক্ষ
মেজাজে।
“বিছানায় চলো! ঘুমাতে সাহায্য করব—ছোটবেলায় যেভাবে ঘুমিয়ে দিতাম।
তোমার মনে নেই? সেই কচ্ছপ মায়ের গল্প করতাম, শুনতে শুনতে তোমরা ঘুমিয়ে
পড়তে,’’ মা বললেন।
“কচ্ছপ মায়ের গল্প ছোটবেলায় চলত, এখন চলবে না। অপেক্ষা করো। ঘুমিয়ে
পড়ার লেটেস্ট সংস্করণ নিয়ে আসছি।” মি. চ্যাটার্জী চলে গেলেন।
তার পড়ার খোরাক ছিল বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ে লেখা বইগুলো। শোবার
ঘরে ঢুকলেন এবং কিছুক্ষণ পর মোটাসোটা একটি বই নিয়ে ফিরে এলেন। বইটির
নাম India Divided,লেখক রাজেন্দ্র প্রসাদ—যিনি ভারত প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি
এবং একজন স্বাধীনতা কর্মী এবং বিশিষ্ট গান্ধিয়ান।India Divideএর বেশির ভাগ
অংশ কারাগারে বসে লেখা হয়েছিল এবং এটি ভারত বিভক্ত হওয়ার এক বছর আগে
১৯৪৬সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
“এটি ধরো এবং পড়তে শুরু করো। কখন ঘুমিয়ে পড়বে টের পাবে না,” মি.
চ্যাটার্জী রহস্যময় হাসি দিলেন।
“এটি একটি ঐতিহাসিক ও জ্ঞানগর্ভ বই। এ ধরনের বই প্রস্তুতি নিয়ে ঠান্ডা মাথায়
পড়তে হয়। এখন পড়তে যাওয়া মানে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।” মুখ কালো করল
সাবিত্রী।
“আমার জ্ঞান মতে, রোম্যান্স এবং থ্রিলে ভরাpage-turnerবই তোমাকে কখনই
ঘুমাতে সাহায্য করবে না। বরং এধরনের বই তোমাকে বইয়ের শেষ অবধি টেনে নিয়ে
যাবে। শুধুমাত্র ভারী বই ঘুমাতে সাহায্য করে,” বললেন তিনি বিশেষজ্ঞের মতো, “তবে,
যখন পড়বে তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়বে। বসে বা অন্য কোনো ভাবে নয়। বইপড়া
ঘুমের ক্ষেত্রে কীভাবে যাদুর মতো কাজ করে, নিজেই বুঝবে।”
“তা ঠিক,” মিসেস চ্যাটার্জী তাল মেলালেন। হঠাৎ তার মনে পড়ল গয়নার বাক্সের
কথা যা খোলা অবস্থায় রেখে এসেছিলেন। তিনি ছুটে গেলেন পাশের ঘরে, তারপর
হতবাক হলেন। গয়নার বাক্স উল্টানো। বাকি গয়নাগাটি ঠিকঠাক থাকলেও একটা চেইন
খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সন্দেহের প্রথম তীরটা তার স্বামীর দিকেই। কারণ, তিনিই এইমাত্র
এই ঘরে এসেছিলেন।
হন্তদন্ত হয়ে স্বামীর কাছে ফিরে এলেন তিনি। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ”চেইনটা
নিয়ে কোথায় রেখেছ?” হাউমাউ করে কেঁদেকেটে চোখের জল নাকের জল একাকার করে
আবার বললেন, “ওরে মা সাবিত্রী, ওরে মা রাত্রি, তোমাদের বাবার হাত শর্ট, আমাকেই
বলতে পারত। তাই বলে চেইনটা চুরি করবে! আমি কি গয়নাগাটি শ্মশানে নিয়ে যাব?”
মি. চ্যাটার্জী ভেবাচেকা। ঘরের বউ সন্দেহ করলে এর চেয়ে বড় বিপদ আর কী
হতে পারে! খানিকক্ষণ থ মেরে থেকে বললেন তিনি, “তোমার মাথা ঠিক আছে তো?”
“আমার মাথা ঠিক আছে! তোমার মাথা ঠিক নাই! ঠিক থাকলে কেউ বউয়ের গয়না
চুরি করে?” গরম কড়াইয়ে তেল পড়ার মতো ছ্যাঁৎ করে উঠলেন তিনি।
মি. চ্যাটার্জী’র হতভম্ব ভাব কাটছিল না কিছুতেই। একটু একটু করে যখন স্বাভাবিক
হয়ে এলেন, তখন বললেন তিনি, ”এতবছর ধরে ঘরসংসার করার পরও আমাকে চিনতে
পারলে না?”
“তাহলে কে চুরি করেছে? তোমার মেয়েরা?” হঠাৎ বললেন তিনি।
সাবিত্রী ভয়ানক রেগে গেল, “মা, আমরা ওই ঘরে যাই-ই নি! তোমার গয়নার বাক্সে
আমরা থুথু দেই।”
মি. চ্যাটার্জী মেয়ের কথায় শরম পেলেন। তিনি বউকে টেনে নিয়ে গেলেন পাশের
ঘরে, তারপর বললেন, “ঘরটা ভালো মতন খুঁজে দেখেছ?”
“খুঁজতে হবে কেন? ঘরে কি ভুত আছে?”
“থাকতেও তো পারে।”
মি. চ্যাটার্জী তন্ন তন্ন করে ঘরটা খুঁজলেন। অবশেষে খাটের নিচে ময়লা ঝুড়ির
পাশে চেইনটা দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওই তো—ওই তো চেইন!”
তারপর নিচু খাটের নিচে কষ্ট করে মাথা ঢুকিয়ে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চেইনটা বের করে
আনলেন। স্ত্রী’র হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এবার শান্তি পেয়েছ?”
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পাল্টা বললেন তিনি, ”তুমি ছাড়া এই কাজ আর কে
করেছে?”
মি. চ্যাটার্জী এতক্ষণ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছিলেন, এবার তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে
গেল। কড়া মেজাজে বললেন, “আলমিরা তালাবদ্ধ করে এখনই ওই ঘরে যাও! আমার
সঙ্গে ঘুমাতে পারবে না! দিস ইজ মাই অর্ডার!”
অগত্যা মুখ কালো করে তিনি মেয়েদের ঘরে এলেন।
মাকে মনমরা দেখে, সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করল, “এখনো পাওনি?”
“পেয়েছি,” বললেন তিনি, ক্ষীণ স্বরে।
“তো?”
“তোমার বাবা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।”
“কেন?”
“সন্দেহ করেছি, তাই।”
“বাবা ঠিক কাজটিই করেছেন। আমিও তাই করতাম।”
“তুমিও কী তোমার বাবার মতো নিষ্ঠুর?”
“বাপ কা বেটি না!”
তারপর সে ছাদের দিকে তাকাল। কোনোকিছু শোনার ইচ্ছে তার নেই, এরকম ভাব
করে। একরকম কোণঠাসা হয়ে মিসেস চ্যাটার্জী মেঝেয় বিছানা বিছিয়ে শুতে গেলেন,
সাবিত্রী’র নিষ্ঠুরপণা যেন বেড়েই চলল—“মা, এখানে ঘুমাতে পারবে না! যদি ঘুমাও,
আমরা দু’বোন বাইরে চলে যাব।”
অগত্যা তিনি ডাইনিং রুমে এসে কুকড়িমুকড়ি হয়ে শুয়ে সারাদিনের স্বপ্ন ঝাঁপবন্দি
করে অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লেন।
সাবিত্রী অনিচ্ছার ভারে অতিষ্ঠ ভাব নিয়ে বইটি পড়তে লাগল, কিন্তু তার মনোযোগ
তাকে ঘনঘন ধোঁকা দি”িছল। হঠাৎ রাত্রি আগ্রহের সাথে বলল, “দিদি, তোমার মাথা
টিপে দেই?”
সাবিত্রী তখনো খিটখিটে মেজাজে ছিল, নিজেকে শান্ত করল। কিছুক্ষণ পর, কী
উদ্দেশ্যে, তাকে কাছে ডাকল সে, “শোন! যখন ঘুমিয়ে পড়ব, তখন লাইট অফ করে
দিস এবং কোনো সাড়াশব্দ করবি না। মনে থাকবে তো?”
সাবিত্রী সটান শুয়ে বইটি যত্ন সহকারে তার পেটের উপর রাখল এবং তারপর চোখ
বন্ধ করল। রাত্রি তার মাথা টিপতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে গেল।
দিদিকে ঘুমুতে দেখে রাত্রি লাইট অফ করে তার বিছানায় গেল। কিছুক্ষণ পর ঘুম তাকেও
ক্ষমা করল না। টেনেহেঁচড়ে তাকে তার দখলে নিল।
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন সাবিত্রীকে ভয়ঙ্কর যানে তুলে রণক্ষেত্রে নিয়ে গেল। তার
চিরচেনা ভার্সিটিই সেই রণক্ষেত্র।
“পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ভারী অস্ত্র যেমন ট্যাঙ্ক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট লাঞ্চার,
ভারী মর্টার এবং হালকা মেশিন গান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করছিল। তারা
পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলেছিল এবং অবিরাম গুলি বর্ষণ
করছিল। তারা আবাসন, ছাত্রাবাস এবং স্টাফ কোয়ার্টারে প্রবেশ করে প্রভোস্ট, শিক্ষক,
অধ্যাপক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের হত্যা করছিল এবং ধ্বংস করে দিচ্ছিল তাদের
মুখোমুখি ভবন ও গাছ। সর্বত্র রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ, চিৎকার ও কান্নাকাটি!
আকাশ ও বাতাস ভারী হয়ে এসেছিল। ছাত্ররা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল। কখনো নির্জন
ভূমির মধ্য দিয়ে, কখনো পড়োপড়ো ভবনগুলোর ফাঁক-ফোকর দিয়ে। রাসেল তাদের
মধ্যে ছিল। সামরিক বাহিনী তাদের ধাওয়া করছিল এবং গুলি চালাচ্ছিল এলোপাতাড়ি।
হঠাৎ একটি গুলি এসে রাসেলকে আঘাত করে। ভয়াবহ বিকৃত লাশের পিরামিডের
কাছে লুটিয়ে পড়ে সে। এবং গোঙাতে থাকে, “সাবিত্রী, আমাকে বাঁচাও! বাঁচাও!” স্বপ্ন
আরেকটু স্থায়ী হলে দেখল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কনভয় টুপিযুক্ত আলখাল্লা পরিহিত
এক সাধুকে আটক করে টেনেহেঁচড়ে প্রিজনভ্যানে তুলছিল এবং সেই ভ্যানটি উদ্ভট রূপে
বাতাসে উড়ে উঠছিল।”
গোঙাচ্ছিল সে, ভয়ে-ডরে ঘামছিল সে। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসল
সে। কপালের ঘাম মুছল। মনে পড়ল তার সেই মোটা বইটির কথা যা তার নিজের
বুকের উপর রেখেছিল। আশপাশ কোথাও নেই। তবে কি রাত্রি এটি সরিয়ে রেখেছে?
না নিয়ে গিয়েছে তার পড়ার টেবিলে? অনিচ্ছাকৃতভাবে, বিছানা থেকে নামল সে এবং
তারপর ঘরের লাইট অন করল। বিদ্যাধরীতুল্য রাত্রি ঘুমাচ্ছিল বেঘোরে, বিরক্ত করল
না তাকে। খিদেয় নিজেকে খুব দুর্বল বোধ করছিল, তাই সে ডাইনিংয়ে গিয়ে সামান্য
কিছু সালাদ সহ রুটি ও পনির খেল। তারপর বইটি খুঁজল। অবশেষে এটি রাত্রি’র পড়ার
টেবিলে খুঁজে পেল। এটি হাতে নিয়ে তার বিছানায় ফিরে এল। শুয়ে শুয়ে বইটি আবার
শুরু থেকে পড়তে লাগল, তবে পড়ায় তার মন আসছিল না। অ¯ি’রতা পিষ্ট করছিল
তাকে এবং উদ্বেগ গিলে খাচ্ছিল—যেভাবে ক্ষুধার্ত অজগর শিংওয়ালা পশু গিলে গিলে
খায়। হঠাৎ গুলির ঠাস ঠাস শব্দ শুনতে পেল সে যা রাতের আকাশে ক্ষত তৈরি করছিল
এবং আন্দোলিত করছিল ঘুমন্ত শহরকে। বইটা একপাশে সরিয়ে রেখে সে ভাবতে শুরু
করল। গত কয়েক দিন ধরে, এক মুহূর্তের জন্যেও রাসেলের খোঁজ করেনি। হঠাৎ
উপলব্ধি করল, অবশ্যই, তার মারাত্মক ভুল হয়েছে। অনুতাপের কাঁটা তাকে বিদ্ধ
করল, এফোঁড়-ওফোঁড় করল। তার মানে সে কি রাসেলের প্রতি অনুরক্ত? তার অবচেতন
মন তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? কেন সে এত চিন্তিত? কার জন্য এবং কীসের জন্য? যুগে
যুগে একে অপরের প্রতি অনুভূতির স্রোত ফল্গুধারার মতো মনের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে,
এর নাম কী? ভালোবাসা? একে অপরের প্রতি দুর্বলতা? ব্যথা? যন্ত্রণা? অদেখা আগুনে
জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া?
হঠাৎ একটি কালো বেড়াল রান্নাঘরে ঢুকল এবং ভুতুড়ে শব্দ করে দ্রুত পালিয়ে
গেল দরজার দিকে। তার চিন্তাভাবনা বাধাগ্রস্ত হলো। নিজেকে শীতল করার জন্য পুরনো
আমলের সিলিং ফ্যানটি বরাবর নিচে বসল। তখন মাঝরাত। হঠাৎ লোডশেডিং। ফ্যানটি
ঘড়ঘড় শব্দ করে বন্ধ হলো। সঙ্গে সঙ্গে, ঘরের ভেতর বাতাসের চলাচলও বন্ধ হয়ে গেল।
মন-কষাকষির গরমে আক্রান্ত হলো সে এবং আবার ঘামতে শুরু করল। প্রকৃতপক্ষে এমন
বাজে অবস্থায় আগে পড়েনি কিংবা পড়লেও এমন বিব্রত ও অসহায় বোধ করেনি সে।
সেই রাতটি ছিল তারাবিহীন। মুখোশ পরা অন্ধকার ছিল চারদিক। তীব্র নীরবতা!
উত্তেজনা, মনোবৈকল্য, বিভ্রান্তি এবং ভীরুতা তার রক্তে বুদ্বুদ করছিল এবং মানসিকভাবে
ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল সে। দেয়ালে একটি চমক লাগানো ঘড়ি ছিল, মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো হঠাৎ এটি কথা বলতে শুরু করল।
“এই, তুমি কেমন আছ?” জিজ্ঞেস করল এটি।
সাবিত্রী প্রথম ভেবেছিল কোনো ব্যক্তির কণ্ঠ। তারপরেই, ওই সন্দেহজনক কণ্ঠের
উৎসের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করল এবং অবশ্যই নিশ্চিত হলো যে এটি তাদের ঘরের
দেয়াল থেকেই এসেছে। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে সে অবাক হয়ে ওদিকে তাকিয়ে
রইল—যেন আশ্চর্য জাদুকরের কথা শোনার অপেক্ষা এবং কখন বিদ্যুৎ আসে!
“তুমি নিশ্চয় বিস্মিত? কে তোমার সাথে কথা বলছে? এটা কোনো ব্যাপার না। যাই
হোক, তোমার নাম কি?” এটি আবার জিজ্ঞেস করল।
সাবিত্রী কোনো উত্তর দিল না।
“আমি তোমার নাম জানি, কিন্তু নামে কিছু যায় আসে না,” বলল এটা, এবং আরো
বলল, “তুমি মনে মনে দুশ্চিন্তার সাথে লড়াই করছ, ঠিক? তুমি কাউকে মরিয়া হয়ে
ভালোবাসো, ঠিক? এবং সে কঠিন সংকটে পড়েছে, ঠিক? এখন, ওকে খুঁজে বের করার
জন্য তোমার সেখানে যাওয়া উচিত, ঠিক? আমার অনুমান খুব কাছাকাছি, ঠিক?”
সে কোনো উত্তর দিল না—হ্যাঁ বা না।
“তোমার উত্তরে কিছু যায় আসে না, তবে তুমি উদ্বেগের মধ্যে আছ, আমি বলতে
পারি, এটা একেবারে সঠিক। জীবনে জটিলতা থাকবে। তবে তুমি চিন্তা করো না! ঝড়
আসে জীর্ণ, প্রাচীন স্থাপনা ধ্বংস করতে এবং শক্তরূপে এটি পুনরায় তৈরি করতে। বড়
ঢেউ তোমাকে বিরক্ত করতে আসে; তবে এটি সত্য, এটি তোমাকে সাঁতারু হতে বাধ্য
করে। ঝামেলা মানুষকে নিখুঁত করে তোলে।” কোনো বাধা ছাড়াই বলে গেল এটি ।
“তোর বকবকানি থামা!” সাবিত্রী রেগে গেল।
“ঠিক আছে! মনে হয় তুমি বিরক্ত হচ্ছ এবং সম্ভবত বিষয়টি তোমাকে ভালোভাবে
বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি,” দেঁতো হাসি দিয়ে বলল এটি, “তবে বেশি অহংকার ভালো নয়।
মিথ্যে অহংকার, খামখেয়ালিপনা, জনবিচ্ছিন্নতা মহাপরাক্রমশালী রাজা-বাদশাদেরও
ধুলোর মানব বানিয়েছে। তুমি যদি ধুলোর মানব না হতে চাও ইংরেজিতে একটি ছড়া
পাঠ করছি মন দিয়ে শোনো—

Ding-dong! Ding-dong! Ding!

Once upon a time

there was a pearly king.

He would like to eat pretzel,

used to wear a magical ring.

Ding-dong! Ding-dong! Ding!

He would like to eat lentil soup,

tease the laggards with an invisible sting.

Ding-dong! Ding-dong! Ding!

হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে এল এবং তাৎক্ষণিকভাবে স্ট্রাইকিং ঘড়িটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু
বলা থেকে বিরত হলো। সাবিত্রী ঘড়িটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল, তবে এর কোনো
পরিবর্তন লক্ষ করল না। এটি আগে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। এছাড়া, তাকে
অবাক করে দিয়ে ঘড়িটি পুনরায় ডিং-ডং করে বাজল। ভাবল সে এতক্ষণ যা ঘটেছে
তা হয়ত হ্যালুসিনেশন। বিষয়টি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে ডাইনিং রুমের দিকে হাঁটতে
গেল। মাকে কুকড়িমুকড়ি অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে তার মনের অবস্থা আরো খারাপ
হলো। মাকে ডেকে নিয়ে ফিরে এল তাদের ঘরে, তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকালে, বাবার চিৎকারে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। রাতটা খুব খারাপ ছিল, তাড়াহুড়ো
করে বিছানা থেকে উঠে দরজাটা আংশিক খুলল।
নিত্যানন্দ চ্যাটার্জী আংশিক খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। সিটে বসার
আগে, বিমর্ষ গলায় বললেন, “বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
“কে বলল?” সাবিত্রী উদাসীন হয়ে জিজ্ঞাসা করল। যদিও সে ধারণা করতে
পেরেছিল; কারণ, তার স্বপ্নের টুপিযুক্ত আলখাল্লা পরিহিত সেই সাধু কোনো সাধারণ
সাধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ সাধু। হয়ত ‘বঙ্গবন্ধু’ সেই অসাধারণ সাধু।
“All India Radio,” বললেন তিনি, “এছাড়া…”
“ভার্সিটি আক্রান্ত,” সাবিত্রী বলল, “অনেক নিরপরাধ ছাত্রকে হত্যাও করা হয়েছে।”
“কে বলল?” জিজ্ঞাসা করলেন তিনি ভ্রু কুঁচকে।
“আমার কাছ থেকে শোনো, বাবা! ঘটনাটি স্বপ্নে দেখেছি!” স্বপ্নের উপর জোর দিয়ে
আত্মবিশ্বাসের সাথে আবার বলল, “পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ভার্সিটিতে আক্রমণ চালিয়ে
বহু ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করেছে। এবং আশ্চর্যরকমভাবে, স্বপ্নে এ-ও দেখেছি, পাকিস্তান
সেনারা একজন সাধুকে পাকড়াও করে তারা তাকে জোর করে প্রিজনভ্যানে তুলছিল।
সাধু এখানে সম্ভবত বঙ্গবন্ধু।”
“হ্যাঁ, তোমার স্বপ্ন মিরাকল,” বললেন তিনি বিস্মিত নেত্রে, “বিশ্বাস করতে কষ্ট
হ”েছ।”
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচল তাকে বিভ্রান্ত করছিল। কীভাবে সম্ভব? স্বপ্ন আর
বাস্তবতা! দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কী? কে বলতে পারে? হয়ত মনোবিশ্লেষণের
জনক ঝরমসঁহফ ঋৎবঁফ এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারতেন; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,
তিনি এই ধরাধামে আর নেই। কাজেই, পিতা হিসাবে তার কন্যার স্বপ্নকে উড়িয়ে না
দিয়ে আমলে নিলেন।
নিজের মাথায় মৃদু চাপড় মেরে, দার্শনিকের মতো বললেন তিনি, “অলৌকিক
ঘটনা এখনো ঘটে। এই কারণে, মানুষ অদৃশ্য শক্তির কাছে বড় অসহায়। এ জগত
চিররহস্যময়, তবে অলৌকিক ঘটনা তার চেয়েও বড় রহস্যময়। কোনো কিছুর ব্যাখ্যা
নেই, কোনো যুক্তি নেই, বাদানুবাদ নেই, সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যাই হোক, আমি তোমার
স্বপ্নের উৎস ধরে বলতে পারি, সম্ভবত যুদ্ধ আসন্ন। এই মুহূর্তে তোমাদের সম্পূর্ণ শান্ত
এবং ধৈর্যশীল হওয়া উচিত।”
“না, বাবা! আমাকে এক্ষুনি বাইরে বেরোতে হবে।” সাবিত্রী তার বাবার চিন্তা
উড়িয়ে দিল।
“বাবা হিসাবে এই মুহূর্তে তোমাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারি না!”
অনমনীয় কণ্ঠে বললেন তিনি। কারণ, তিনি যুদ্ধ এবং কলহ সম্পর্কে ভালোমতন অবগত।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ দেখেছেন তিনি। দেখেছেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ,
গণহত্যা, নরহত্যা, ভ্রাতৃহন্তা, শিশু হত্যা এবং জ্বালাও-পোড়াও। অতএব, তিনি সচেতন
থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। অভিজ্ঞতার আলোকে বললেন তিনি, “ভার্সিটি কেন, ঢাকা
শহর এখন নিরাপদ নয়। তারা পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও অ্যাটাক করে
নির্বিচারে হত্যা করেছে। আগুন ও হত্যাযজ্ঞ ঢাকা এবং এর চারপাশের জেলা সমূহে
ছড়িয়ে পড়েছে।”
বাবার ভয় উপেক্ষা করে এবং নিজের ভয়কে চপেটাঘাত করে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি
নিল; কিন্তু উপর্যুপরি বাধার কারণে পারছিল না সে। মা-ও এসে বাবার মতো প্রাচীর হয়ে
দাঁড়ালেন। ভিজে ভিজে অসন্তুষ্টির সুরে বললেন তিনি, “যখন সবাই তোমাকে নিষেধ
করছে!”
“সবাই না, তুমি এবং বাবা।” সাবিত্রী তার একগুঁয়েমি অবস্থান থেকে একচুল সরল
না, “রাত্রিকে জিজ্ঞেস করো, সে কী বলে, শোনো।”
এড়ষষরড়িম নিয়ে রাত্রি তার বিছানায় ঘুমোচ্ছিল নিষ্পাপ মেয়ের মতো। তার
মা উষ্মা প্রকাশ করলেন। “মেয়েটি এখনো ওঠেনি!” তারপর দেয়াল ঘড়িটার দিকে
তাকালেন। ঘড়িটা তাকে হতাশ করল না। ডিং-ডং শব্দে বাজল। সাতটা বাজতে সাত
মিনিট বাকি। বিছানা বরাবর গিয়ে মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন, “আরে রাত্রি, ওঠো!
দয়া করে ওঠো মা!”
রাত্রি’র ঘুম ভাঙল বটে, কিন্তু ঘুমের জড়তা কাটছিল না। বরং কোনো অদৃশ্য শক্তি
তার মাথা বালিশে ঠেশে ধরছিল। সে তার চোখ খোলে আবার বন্ধ করে। বন্ধ করার আগে
শুধু বলে, “সমস্যা কী?”
মা চিৎকার করেন, “তোমার দিদি বাইরে যেতে চাচ্ছে, সাপোর্ট করো?”
রাত্রি তার চোখ খুলল, বন্ধ করার আগে কোনো রকমে বলল, “যাবে। সমস্যা কী?”
মা আবার চেঁচালেন, “বাইরের পরিস্থিতি ভালো না। কারফিউ চলছে। সে কি
যাবে?”
রাত্রি তার চোখ খুলল, বন্ধ করার আগে পুনরায় বলল, “যাবে। সমস্যা কী?”
তৃতীয়বার মা জোরে জোরে চিৎকার করলেন, “তোমার বাবা রাজি হচ্ছে না। সে
কি যাবে?”
আধো-আধো ঘুমের মধ্যে রাত্রি এবার তার কান ঢেকে আগের মতোই বলার চেষ্টা
করল, “যাবে। সমস্যা কী?”
মা রাত্রি’র উপর বিরক্ত হয়ে খেই হারিয়ে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে সাবিত্রীকে উদ্দেশ্য
করে বললেন, “নরকের দরজা খোলা! যাও! দু’বোন একই নরুন।”
বাড়ির বাইরে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখে সাবিত্রী হতবাক হয়ে গেল। এই গাড়িই-ই বা
কোত্থেকে এল? এতসব না ভেবে কোচম্যানকে বলল, “আপনি এখানে কী করছেন?
জানেন না আজ কারফিউ? জানেন? সভা, সমাবেশ, মিছিল এবং সকল ধরনের যানবাহন
চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও এত সাহস পান কোত্থেকে?”
সত্তরোর্ধ কোচম্যানের মাথায় চাঁদ পাল্লা টুপি। বাতজনিত অসুস্থতার কারণে সামান্য
কাবু মনে হলেও বয়সকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে
বললেন তিনি, “ভয়কে যারা জয় করে তারাই তো এগিয়ে চলে। দয়া করে গাড়িতে উঠুন
এবং আমার প্রতি আস্থা রাখুন!”
ভালো-মন্দ চিন্তা না করেই সে এতে উঠে বসল এবং কোচম্যানকে আদেশ করল
ইকবাল হলের সামনে যেতে।
কোচম্যান তার চাবুকটা সপাং করে বাতাসে চালালেন। ঘোড়া বুঝে গেল তাকে
সামনে ছুটতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই।
রাস্তা ছিল অবিশ্বাস্যরকম ফাঁকা। শহরের মানুষ আতঙ্কে ও ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়নি।
কিছু লোক চলছিল, সত্য, কিন্তু তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা বিভিন্ন গ্রহ থেকে
এসেছে। কারো মুখে রা নেই। ভিড় নেই। ঠেলাঠেলি নেই। মাথা নিচু করে শবযাত্রায়
হেঁটে যাওয়া মানুষদের মতো চলছিল তারা। কোথাও প্রতিবাদ বা মিছিল নেই। এমনকি,
ফেস্টুন বা ব্যানার পর্যন্ত ছিল না।
রাস্তায় দেখা গেল, ছাত্র, পথচারী, ঠিকা শ্রমিক, বেশ্যা, শীর্ণচর্ম বৃদ্ধ এবং হোটেল
বয়দের মৃতদেহের পাশে শহরের খেঁকি কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করছিল। দলে দলে কাক
চিৎকার করে আকাশ বিদীর্ণ করছিল! ভীতিকরভাবে উড়ছিল লাশ খেকো শকুন! ঢাকা
শহর যেন শকুনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল!
চারপাশ তাকিয়ে, কোচম্যান বললেন, “ম্যাডাম, প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই শহরে
বাস করছি, কিš‘ এত লাশ জীবনে দেখিনি। ঢাকা শহর যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশের
বাজার। জানি না, তারা কাদের সন্তান, কার পিতা তারা, কার মা? তারা কার ভাই, কার
বোন?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার বললেন তিনি,”তাদের পরিচয় যাই হোক না কেন তারা
মানুষ। কুকুর নয়, হিংস্র প্রাণীও নয়। তাদেরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে মনে হচ্ছে
তারা কুকুর বা হিংস্র প্রাণী। এটি মানবতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আমি মনে করি একদিন
এই নৃশংস হত্যাকারীরা এই গণহত্যার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবে।”
কথা বলতে বলতে তিনি ভীষণ আবেগাপ্লুত হলেন এবং তার গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে
পড়ল স্রোতধারার মতো।
সাবিত্রীও বিষাদে আক্রান্ত হলো। বলল সে, বিষাদের সুরে, “আমার কী হচ্ছে, আমি
জানি, ভাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সেখানে যেতে হবে। জলদি করুন, প্লিজ!
একমাত্র ঈশ্বর জানেন, তার কী হয়েছে?”
“তিনি কে হন আপনার?” কোচম্যান জিজ্ঞাসা করলেন খুব আগ্রহ নিয়ে।
“আছে না কিছু মানুষ? কেউ-ই নয় অথচ খুব কাছের, ঠিক সে রকম,” সাবিত্রী
বলল, “তাকে খুব মিস করছি। আর এ ভুলটা আমার।” গম্ভীর হয়ে কোচম্যানের উদ্দেশ্যে
ধমকের সুরে এবার বলল সে, “কথা কম বলেন!”
প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ঘোড়ার গাড়ি আধাঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে গন্তব্যে
পৌঁছুল; কিস্তু কোচম্যান ভুলে গিয়ে কিংবা ইচ্ছেকৃত তার ঘোড়ার গাড়ি থামাচ্ছিলেন না।
বাধ্য হয়ে সাবিত্রী ঘোড়ার গাড়ির ছাদে জোরে ঠোকা দিয়ে কোচম্যানকে ঘোড়ার গাড়ি
থামার ইঙ্গিত করল।
কোচম্যান ভড়কালেন না, তবে থামালেন তার ঘোড়ার গাড়ি। সাবিত্রী সেখান থেকে
নামল এবং বিল পরিশোধের জন্য ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করার জন্য অন্যদিকে
একটু সরে গেল। যখন সে ঘুরে দাঁড়াল, দেখল, কোচম্যান নেই তার ঘোড়ার গাড়ি-ও
নেই। সব অদৃশ্য। ভোজবাজির মতো ঘটে গেল সব। হতবাক সে। অনাহূত রহস্যময়তা
তাকে দুশ্চিন্তায় ফেললেও এ নিয়ে ভাবার মতো সময় তার ছিল না। বিতিকিচ্ছি অবস্থার
মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সে; ফলে ভাবার প্রয়োজন মনে করল না। এর চে’ জরুরি রাসেলের
খোঁজ করা। দ্রুত হলে ঢুকল সে এবং হাঁটতে শুরু করল লম্বা করিডোর ধরে। লক্ষ্য
একটাই কক্ষ নম্বর ২৬৯।
করিডোর ছাত্রদের রক্ত ও রক্ত-মাখা কাপড়ে নোংরা। আর বুলেটশেল যত্রতত্র! প্রায়
ডজন খানেক মরদেহ মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং তাদের হাত ছিল পেছনে বাঁধা। রক্ত এবং
মরদেহ ডিঙিয়ে, শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছুল সেই কাঙ্ক্ষিত রুমে। তারপর যা দেখল তাতে
তার মাথা বিগড়ে যাওয়ার উপক্রম।
রুমের মাঝখানে জমাটবাঁধা রক্ত এবং লাশ টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন। রাসেলের
কোনোরকম চিহ্ন না পেয়ে ভবনের ছাদে গেল সে। যদি সেখানে লুকিয়ে থাকে! সেখানেও
পেল না তাকে। তবে যা দেখল তা লোমহর্ষক, বেদনাদায়ক ও মানবসভ্যতাকে কলঙ্কিত
করার জন্য যথেষ্ট। একজন স্টাফ সদস্যের লাশ পানির ট্যাঙ্কের পাশে পড়েছিল। দু’পাশে
তার হাত প্রসারিত। সম্ভবত তার সাত এবং আট বছর বয়সী দু’জন অপুষ্ট সন্তান পড়েছিল
তার উপরে। তাদের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে পড়েছিল। “হায় ভগবান!” বিস্ফারিত চোখে
বলল সে।
কোথাও রাসেলের টিকিটি না পেয়ে হতাশ হয়ে যখন হলের বাইরে এল, তখন সে
ইংরেজির অধ্যাপক আহাদ উল্লাহ চৌধুরিকে দেখতে পেল। অতিরিক্ত প্রতিভাবান হওয়ার
কারণে ঈর্ষা করে অনেকেই তাকে ‘পাগল’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এএফপি’র
সাংবাদিকদের কাছে ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ব্রিফ করবেন তিনি, তাই
ইকবাল হলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাক্ষাৎকার দেবেন, হয়ত সে-কারণে
তিনি পরিপাটি পোশাক পরেছিলেন এবং চুলের উজ্জ্বলতার জন্য ব্যবহার করেছিলেন brilliantiর। ক্যামেরা-লাইট অন হওয়ার আগে সাবিত্রীকে দেখে ফেললেন তিনি। সন্ত্রস্ত
কণ্ঠে বললেন, “বোকা মেয়ে কোথাকার! শহরের অবস্থা ভয়াবহ! কবরস্থান থেকে সিনেমা
হল, বুকশপ থেকে কফিশপ সর্বত্র মৃতদেহ। তোমার ভালোর জন্য ফিরে যাও!”
ভীতু মহিলার মতো ফিরে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। কেনই বা ফিরবে সে? কারণ, সে
খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার সবচে’ প্রিয় একজনকে! যাকে সে এখনো খুঁজে পায়নি! যার জন্য
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির বাইরে সে। যে মানুষটি তার অনুভূতির পূর্ণ বিস্তার—যাকে
ছাড়া তার জীবনের অর্থ অর্থহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক—যাকে ছাড়া তার পৃথিবী ক্রন্দনশীল
এবং বিষাদময়।
রাসেলের জন্য, তার প্রিয় মানুষটির জন্য, যখন সে মানসিকভাবে প্রায় ভেঙে
পড়ছিল এবং তার মাথা যখন ব্যথায় টনটন করছিল, তখন হঠাৎ সত্তর বা তার কাছাকাছি
বয়সী একজন রাস্তার ফক্কড়ের সাথে দেখা। তার মাথার চুল আইনস্টাইনের মতো
আউলাঝাউলা এবং চোখের নিচটায় ফোলা ফোলা। তাকে উদভ্রান্তভাবে হাঁটতে দেখে
ফক্কড় যেচে কথা বললেন তার সাথে এবং সব শুনেটুনে পরামর্শ দিলেন ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালে যেতে।
তার আবেগ ও অনুভূতি তাকে নিয়ে গেল সেখানেই। প্রথমে ঢুকল জরুরি ওয়ার্ডে।
সেখানে প্রচুর আহত ছাত্র ও অচেনা লোক ডাক্তার এবং নার্সদের দ্বারা পরিষেবা নিচ্ছিল।
আহত মানুষের আকাশ-বিদীর্ণ করা চিৎকার এবং কান্নাকাটিতে জরুরি ওয়ার্ড ভারাক্রান্ত
হয়ে উঠেছিল। কিছু ছাত্র তাদের বোধশক্তি হারিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল শুধু।
আহত মানুষের সংখ্যা এত বেশি চিকিৎসক এবং নার্সরা তাদের পরিষেবা দিতে হিমশিম
খাচ্ছিল। কোথাও রক্তের দাগ, ন্যাকড়া, ব্যান্ডেজ, থ্রেড এবং টিস্যু পেপার ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যুদ্ধের ময়দানে অন্তর্র্বর্তীকালীন হাসপাতালের মতো।
রাসেলের সন্ধানে, হাসপাতাল তন্ন তন্ন করে খুঁজল সে, কিন্তু কোথাও পেল না
তাকে। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে কর্তব্যরত একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো সে।
“মাফ করবেন! আমি একজনকে খুঁজছি। ভার্সিটির ছাত্র সে।”
“তুমি কি এখান থেকে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছ? আমার তো মনে হয় ‘না’! দেখছ
তো আমরা এখন সিরিয়াস ব্যস্ত,” বললেন তিনি।
তার স্বরে বিরক্তির আভাস ছিল, কিন্তু সাবিত্রী মনঃক্ষুণ্ন হলো না। বরং কাপাস হাসির
চেষ্টা করে বলল সে, “স্যার, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু হেল্পলেস।”
ডাক্তার হঠাৎ পাল্টে গেলেন। তিনি অদ্ভুত আচরণ করলেন। বাঁ দিকের জুলপি
চুলকাতে চুলকাতে উদাসীনতার ভান করে তারপর বললেন, “মর্গে অনেক লাশ পড়ে
আছে। দেখতে পারো।”
সাবিত্রী তাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর হাসপাতালের মড়িঘরের দিকে এগিয়ে
গেল। মড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো ঈশ্বর হয়ত এখানে পা পিছলে পড়ে
গিয়েছিল। তার অভিশাপে মড়িঘরটি স্থাপিত হয়েছে এখানে।
ভেতরে ঢুকে দেখল সারি সারি লাশ! সাদা কাফনে ঢাকা। থেকে থেকে, দুর্বল
আলো কোথা থেকে এসে মৃতদেহের উপর পড়ছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই আলো
আবার মিলিয়েও যাচ্ছিল। পরিবেশ ছিল শান্ত, ভীতিকর এবং গা ছমছমে! তার গা কাঁটা
দিয়ে উঠল! মড়িঘরের কর্মচারীর সহায়তায় রাসেলের মৃতদেহ শনাক্ত করার চেষ্টা করল
সে, যদি থাকে! তবে তাকে বেজায় হতাশ হতে হলো। রাসেল বা তার মৃতদেহ কোথাও
ছিল না। রাসেলের রুমমেটের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এই তো সেদিনের
কথা, তরতাজা বুদ্ধিদীপ্ত মুখটি ভেসে উঠল তার সামনে। সিঁড়ির গোড়ায় দেখা হয়েছিল।
পরাবাস্তবতার মতো তার মৃত্যু তার চোখের সামনেই ঘটতে লাগল। কুঁকড়ে উঠল সে।
তার অবস্থা দেখে মড়িঘরের পরিচারক ত্রাহি মধুসূদন। মুখ উপরের দিকে তুলে
বললেন, “হে আল্লাহ, রক্ষা করো!”
“ঘাবড়াবেন না।” স্বাভাবিক হয়ে এল সে।
“ঘাবড়াইনি। আপনার মুখ দেখে বিচলিত বোধ করছি।” পরক্ষণে বললেন, “আপনি
যাকে খুঁজছেন, নিশ্চয় তিনি আপনার প্রিয় মানুষ। প্রেম হলো এক ধরনের সাইকিডেলিক
সংগীতের মতো যা আপনাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পাগল করবে। সুতরাং, এই
গানটি মনে মনে শুনুন এবং তার অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আশা করি, আপনি তাকে অন্য
কোথাও পেয়ে যাবেন।”
সাবিত্রী তার কথায় সন্তষ্ট, “আপনার বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ এবং আমাকে সমর্থন করার
জন্য ধন্যবাদ।” তারপর সে মড়িঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, এই সময়, তিনি পেছন থেকে
ডাকলেন। সাবিত্রী ঘুরে দাঁড়াল। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন আন্তরিক গলায়, “আপনি
কি সেখানে গেছেন?”
সাবিত্রী ইতস্তত তাকাল, “কোথায়?”
“পিজি হাসপাতাল,” বললেন তিনি শান্ত কণ্ঠে। তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ নেই।
বর্তমান অবস্থার কারণে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ডাকাবুকো ভাব নেই। যেন বরফের
মূর্তি! এরকম হিমশীতল থাকার পেছনের কারণ কী, একমাত্র আল্লাহ জানেন। আবার
বললেন, “সেখানে তিনি থাকতে পারেন! অনেক আহত ছাত্রকে জায়গার অভাবে সেখানে
পাঠানো হয়েছে। যদিও ওইটা একাডেমিক ভবন, কিন্তু অনেক ডাক্তার সেখানে আছেন।”
“না, আমি এখনো যাইনি,” সাবিত্রী বলল, “তবে এক্ষুনি যাচ্ছি।”
ততক্ষণে সূর্য বেশ সাবালক; যে পৃথিবী চিৎপটাং হয়ে ভেরেণ্ডার তেল গায়ে মাখছিল
তার সঙ্গে খেয়ালি খেলা খেলছিল। কারফিউয়ের কারণে রাস্তায় কোনো যানবাহন ছিল
না। না মানুষের চলাফেরা। একরাত আগে, যে রাস্তাগুলো ছিল কর্মচঞ্চল ও প্রাণচঞ্চল,
ঠিক একরাত পরেই সেই রাস্তাগুলো অবিশ্বাস্যরকম ফাঁকা। শুধুমাত্র কুকুর এবং মাংসাশী
প্রাণীর আনাগোনা ছাড়া। কাকের একটি ঝাঁক বিশৃঙ্খলভাবে উড়ছিল। আরেকটি ঝাঁক
বৈদ্যুতিক তারে বসে উচ্চস্বরে কা-কা করে এলাকাটিকে নরকগুলজার করে তুলছিল।
যদি আশপাশের জঙ্গলে হায়েনাদের ঝাঁক থাকত, হয়ত তারাও ছুটে আসত লাশগুলো
ছিঁড়েফেঁড়ে খেতে।
সোজাপথে সাবিত্রী এগিয়ে গেল, শহীদ মিনার পর্যন্ত। সেখানে সে লাশের গন্ধ পেল।
কপিশ রঙের পাথুরে দেয়ালে এক বারাঙ্গনার লাশ পড়ে থাকতে দেখল এবং আরো লাশ
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার।
এক কথায় সে অসহায় ছিল। আস্তে আস্তে হাঁটছিল। হঠাৎ একজন, তার পূর্ব পরিচিত,
তাকে টেনে নিয়ে গেল জগন্নাথ হলে। সেখানকার ভয়াবহ ম্যাসাকার দেখাতে।
গতকাল যে জায়গাটি ছাত্রদের পদভারে প্রকম্পিত ছিল, ঠিক একদিন পরে, সেই
জায়গাটিই যেন মৃত্যুর হিমশীতল উপত্যকা! ছাত্রদের ডেডবডি, শিক্ষকদের ডেডবডি,
স্টাফদের ডেডবডি এবং অপরিচিতদের ডেডবডি! কান্না এখানে থেমে গিয়েছিল! বাতাস
বোবা-বধিরের মতো আচরণ করছিল! মানবতা গুমরে কাঁদছিল! ডেডবডি, রক্ত, রক্তের
দাগযুক্ত পোশাক, প্রাণঘাতী বুলেট এবং বারুদের গন্ধে ঈশ্বরও যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল!
হঠাৎ সে শুনতে পেল অলৌকিক গুলির শব্দ, ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, যা আসছিল অস্পষ্ট কোনো
স্থান থেকে। এটি ঘটছিল তার খাপছাড়া মনে, পরাবাস্তবতার মতো। কতিপয় বিদেশি
সাংবাদিক লাশ ও ধ্বংসযজ্ঞের ছবি তুলছিলেন। সে, দুরু দুরু চিত্তে, সেখান থেকে
পালিয়ে এল।
টিএসসিতে এসে দেখে সেখানেও অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রমনা রেসকোর্স মাঠ
থেকে ধোঁয়া উঠছিল; সেদিকে তাকিয়ে দেখল প্রাণের চে’ প্রিয় কালী মন্দিরটি মর্টারের
আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তার মনে বেদনার পাথর ঠোকাঠুকি করল। অবসন্নতা তার রক্তের পিঁড়িতে পা
ছড়িয়ে বসল। বাসায় ফিরতে বাধ্য হলো সে। (চলবে)

 

আরো পড়ুন