এক সপ্তাহ পর আবার গেলাম কান্দাপট্টি নিষিদ্ধপল্লীতে। দেখা হল শিউলির সঙ্গে, ঘুরতে বের হলাম পল্লীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। কারণ একটাই, আগামী ছয়/সাত মাসের মধ্যে এই পল্লীর কিছু প্রভাবশালী বাড়িওয়ালীর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, যাতে আমি আমার শুটিং ইউনিট নিয়ে কোনরকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই ডকুমেন্টরির কাজটি সেরে ফেলতে পারি।
অন্য এক সপ্তাহে ঘুরতে গিয়েছিলাম পতিতাপল্লীতে, আমি ও মামুন ভাই যাচ্ছিলাম নার্গিস আপার সাথে দেখা করব বলে, গলি দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ কানে আসল-
খা…পো….মুখে নিয়ে খেলার আর জিনিস পাইলি না?
আমরা সামনে এগুতে গিয়েই পিছন ফিরে তাকাতে দেখি কয়েকটি ছোট্ট শিশু, ছোট্ট একটি ঘুপরি ঘরের জানালার বাহির দিকের নোংরা ড্রেনের উপর পরে থাকা কয়েকটি বেলুন মুখে নিয়ে, ফুলিয়ে খেলা করছিল, তা দেখে তাদের মা উত্তেজিত হয়ে ঐ কথাগুলি বলছিল। এখন বাচ্চা গুলোকে মারার জন্য এগিয়ে যেতেই মামুন ভাই মহিলাটিকে কিছুটা ধমকের সুরে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। আসলেই, এখানে জন্মগ্রহনকারী শিশুরা তাদের জীবনের প্রাপ্ত অধিকারগুলির কত অংশ ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে তা আমার মাথার মধ্যেই ঢুকছেনা, যদিও কিছু এনজিও তাদেরকে নিয়ে কাজ করছে। নার্গিস আপার সঙ্গে দেখা করার পর সেইদিনের মতো ঢাকাতে ফিরে আসলাম।
Human being!! is the meaning of human being- sound health and good looking of either a man or woman??? No!! He who goes ahead with justice and considerable mind and there is no animalism in his mind is human being.
মানুষ!
মানুষ মানেই কি সুস্থ -সুন্দর দেহের ফ্রেমে বাঁধা কোন সুদর্শন পুরুষ কিংবা নারী!
না!
এানুষ ত সেই, যার মধ্যে থাকে না কোন পশুত্ব, যে তার বিচার-বিবেক বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে চলে সামনের দিকে।
“Obscure Expose’
“অন্ধকারের আলো”
আমার ডকুমেন্টরির মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে
” জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হউক ভাল”একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুটি যদি খারাপ পরিবেশে বেড়ে উঠবার সুযোগ পায় তাহলে সে খারাপ হতে বাধ্য! তেমনি রাস্তার নোংরা পরিবেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুটি যদি সমাজের আদর্শবান কোন পরিবারে বেড়ে উঠবার সুযোগ পায় তবে সেই শিশুটিও একদিন সুন্দর মানুষরুপে গড়ে উঠবে, এটিই স্বাভাবিক।। পতিতাপল্লীতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা কি ভালো পরিরেশে বেড়ে উঠবার সুযোগ পেলে, সে কি সভ্য সমাজের একজন আদর্শবান মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারবে না!
আমি শিউলিকে নিয়ে পল্লীর গলিতে গলিতে ঘুরতে লাগলাম। অসংখ্য নারী পুরুষের গাদাগাদির মধ্যে আমরা হেঁটে চলেছি। আমার সঙ্গে একজন ক্যামেরা পারসন রয়েছে ভিডিও করার জন্য। আমাদের ক্যামেরায় তখন ধরা পড়ে পতিতাপল্লীর নব-যৌবনা নারীদের উৎকন্ঠা মিশৃত আঁচরণের দৃশ্য।
একটি নারী যৌনকর্মী তার কাষ্টমারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে:
ঐ…বেডা…ঐ….
বসবি?
ওরে…এই, শোন শোন
নারীটির কথাগুলোকে কর্ণপাথ না করে কাষ্টমার অন্য গলির দিকে এগিয়ে গেলে বলে ওঠে:
যাও যাও, তোমারে নিয়ে আমাগো পিঠা খাওয়ানোর শখ নাই
যাও যাও.. অন্য বাড়িতে গিইয়া ঘুমাও!
আমি ও শিউলি বিভিন্ন গলির নোংরা রাস্তা ধরে হাঁটছি। একটি মেয়ে মুড়ি মাখার দোকান থেকে মুড়িমাখা কিনছে। আমাদের ক্যামেরা তার দিকে তাক করলে, তার পাশে দাড়ানো একটি মেয়ে ওর্নাতে মুখ লুকালে সে ক্যামেরার দিকে মুখ উচিয়ে বলতে থাকে:
বার বেডার সামনে সায়া (পেটিকোট) উঁচাইলে দোষ হয়না, হেতেরা ভিডিও করলেই দোষ? ভিডিও করেন, বেশী করে ভিডিও করেন।
এমন হাজারো মনের নবীন-উচ্ছাসে যখন নারীরা তাদের খদ্দের প্রাপ্তির চাহিদার কথা প্রকাশ করে, তেমনি অন্যদিকে বুকের সুগভীর সীমানা জুড়ে বইতে থাকে হাজারো না বলার কষ্ট-কাহিনী। একজন মা তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বলে ওঠেন:
আমাগো দশ জনের দরকার নাই, আমরা এক ব্যাটার পায়ের নিচেই ভাত খাইবার চাই
সমাজ কি সে সুযোগ দিবে আমাগো?
আমার কাছে মেয়েটির সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নাই,যদি আপনাদের জানা থাকে তাহলে জানিয়েন।
এই নিষিদ্ধপল্লীতে প্রতিনিয়ত জন্মগ্রহণ করছে অসংখ্য অনাকাজ্ঞিত শিশু। জন্মের পর থেকেই তারা এই জ্বলন্ত আগুনের কুপে তারা জ্বলছে। আর এ কারনেই আমাদেরকে উদ্দেশ্য কওে ছোট্ট একটি শিশু বলে:
আমার এই পরিবেশ ভালো লাগে না, আমাকে এখান থেকে বাহিরে নিতে পারেন?
এমন অসংখ্য প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, তাদেরকে সেই প্রশ্নের উত্তর আজও দিতে পারিনি। তবে আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজ দিতে পারবে কি না,তা আপনাদের কাছেই জবাব চাইলাম।
হতভাগা এক বয়ষ্কা নারীর প্রশ্ন:
আমি ত্রিশ/চল্লিশ বছর ধরে এই পল্লীতে আছি। আমি এই জায়গায় থেকে আমার সন্তানকে খারাপ বানামুনা, একটাই মেয়ে আমার, আমি কিতা করতাম? আমার যাওয়ার রাস্তা কোথায়?
স্কুলে যেতে ইচ্ছুক শিশুদের প্রশ্ন:
আমরা পড়া-লেখা করে অনেক বড় হতে চাই, আমাদের দোষটা কোথায়?
কেউ কি দিতে পারেন তাদের এমন প্রশ্নের উত্তর?‘
আমিও পারিনি, চেষ্টা করেছি তাদের কষ্টের জীবন-জীবিকা সেলুলয়েড এ তুলে ধরবার…
ছি! ছি! তুই ওদেরকে নিয়ে কাজ করিস?
তুই…তো বেশ্যা হয়ে গেলি রে।
তুই…তো প্রচুর মাগি….লাগাইসস।
তোর রুচি হয় কিভাবে?
আরও কত প্রশ্ন-অভিব্যক্ত আপনাদের!
পৃথিবীর সু-প্রাচীন এই পেশাকে ধরেই তাদের জীবিকা। কেউবা মায়ের পেশাকে গ্রহণ করে, কেউবা ভালবাসায় প্রতারিত হয়ে, কেউবা কিছু অসভ্য কাল হাতের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ঠাঁই নিয়েছে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে।
এরা সবাই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, কিন্তু হারিয়েছে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। তারপরও তারা নিজেকে সাজায়, সাজে নিত্য-নতুন সাজে, আর এভাবেই স্বপ্ন দেখে নতুন ভাবে বেঁচে থাকার। (চলবে)

