গাজী রাকায়েত একজন সৎ চলচ্চিত্রকার, একজন দার্শনিক

হুমায়ূন ফরিদ

by sondeshbd.com
319 views

গাজী রাকায়েত হোসেন একজন নন্দিত অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। গত দুই দশক ধরে তিনি মঞ্চ ও পর্দায় সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিককালে তাকে আমরা পুরোপুরি কমার্শিয়াল সিনেমাতে যেমন দেখেছি, তেমনি নতুন করে শুটিং শুরু হতে যাওয়া ‘কাঠগড়ায় শরৎচন্দ্র’র মতো আর্ট-হাউজ ঘরনার সিনেমাতেও তিনি থাকবেন বলে শোনা যাচ্ছে। যাই হোক – চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা কিংবা প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে বেশ কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের সাথে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি ‘মৃত্তিকা মায়া (২০১৩)’, ‘অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫)’, এবং ‘গোর (২০২০)’ চলচ্চিত্রের জন্য অনেকগুলি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। উইকিপিডিয়ায় দেখলাম, রাকায়েত ভাই ১৯৮৩ সালে গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৫ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন। এরপর ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই ছেলেবেলাতেই তাঁর শিল্পযাত্রা শুরু হয়। ১৯৮০ সালে তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন – তখন থেকেই ‘হালচল’ নামের একটি মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে তিনি গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দেন। তাঁর অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটকের পরিচালক ছিলেন সৈয়দ মহিদুল ইসলাম।

গাজী রাকায়েত ভাই আমাদের ছেলেবেলার হিরো। আমাদের জেনারেশনের ইউনিভার্সিটি লাইফ শুরু হয়েছে বিটিভি-তে প্রচারিত নাটক, ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, আর ছায়াছন্দ দেখে। আমার স্পষ্ট মনে আছে – ১৯৯৫/৯৬ সালে আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন আমরা সিনেমার চেয়ে টেলিভিশনই বেশি দেখতাম। টিভি নাটকগুলি তখন ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। আমরা আফজাল হোসেন, সূবর্ণা মোস্তফা, আসাদুজ্জামান নূর, রাইসুল ইসলাম আসাদ, খালেদ খান, হুমায়ূন ফরিদী কিংবা তারিক আনাম খানদের অভিনয় গোগ্রাসে গিলতাম। তাদের পর পরই এলেন গাজী রাকায়েত, তৌকির আহমেদ, জাহিদ হাসান, টনি ডায়েস, আজিজুল হাকিম, আফসানা মিমি, বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার ও আরও অনেকে।

এ্যানিওয়ে, আমি রাকায়েত ভাইকে প্রথম দেখেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের নীচে। সেদিন তিনি একটা র‍্যাডিশ অথবা পিংক কালারের জীপ গাড়িতে চড়ে আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। সম্ভবত নিশান কোম্পানীর গাড়ী ছিল সেটি। পরবর্তীতে টেলিভিশনে তাঁর অনেক নাটক দেখেছি। অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডও আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফসানা মিমির সাথে রাকায়েত ভাইয়ের প্রেম, বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিয়ে তখনকার পত্র-পত্রিকাগুলিতে বেশ লেখালেখি হত। আমরা সেগুলিও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম।

রাকায়েত ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম সামনা-সামনি দেখা হয় ২০১৩ সালে, এনটিভি-তে। আমার প্রযোজিত ‘শুভসন্ধ্যা’ অনুষ্ঠানে। ততদিনে আমি দেশ-বিদেশে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে এনটিভি-তে ‘প্রোগ্রাম প্রডিউসার’ হিসেবে জয়েন করে ফেলেছি। ইন ফ্যাক্ট, তাঁর সাথে আমার পথচলা সেই থেকে শুরু। আমি বিভিন্ন কারনেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। ডিরেক্টর হিসেবে বাংলাদেশে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ধোঁয়াঘর’ নাটকটি দিয়ে। এই নাটকটি ২০১৩ সালে এনটিভি-তে প্রচারিত হয়েছিল এবং এই নাটকটির জন্যেই আমি ২০১৩ সালের চারুনীড়ম কাহীনি চিত্র উৎসবে ‘বেস্ট ডিরেক্টর’ এ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম দেখা আর এনটিভি’র ‘শুভসন্ধ্য’ প্রোগ্রামে দ্বিতীয় দেখার মাঝখানে কেটে গেছে প্রায় এক যুগ। এই সময়ে রাকায়েত ভাই অভিনেতা থেকে নির্দেশক হয়েছেন, নিজে নতুন দল গড়েছেন, মঞ্চনাটক লিখেছেন, মিমি আপার সাথে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, আরও অনেক কিছু ঘটেছে। ২০১৩ সালের পর আবার আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে। তাঁকে আমি দেখেছি ডিরেক্টর’স গিল্ডের বিভিন্ন মিটিংয়ে, কিংবা শিল্পকলা একাডেমিতে। এনটিভি-তেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। আসলে রাকায়েত ভাই সবসময় দেশের উল্লেখযোগ্য সব কালচারাল ইভেন্টে ছিলেন এবং আছেন। তিনি তো একাধারে একজন নেতা, শিক্ষক ও সংগঠক। শিল্পী তো বটেই! তো এই মানুষটির সাথে এবার আমার ঘনিষ্ঠতা হলো মহাত্মা ভ্যালেরি আন টেইলর প্রতিষ্ঠিত ‘সেন্টার ফর দ্যা রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্যা প্যারালাইজড (সিআরপি)’ এর সিনেমা করতে যেয়ে। সিআরপি তাদের আউটরিচ কম্যুনিকেশন জোরদার করার জন্য মাঝেমধ্যে বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। তাদের প্রথম সিনেমা ছিল ‘বিহঙ্গ, ডিরেকশন দিয়েছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার, নির্দেশক, ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তারই ধারাবাহিকতায় এবার সিআরপি বানাচ্ছে ‘মানুষটিকে দেখ ‘সি দ্যা পার্সন’। এই সিনেমাটি পরিচালনা করছেন আমাদের প্রিয়জন ু নন্দিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা গাজী রাকায়েত। এটি অফিশিয়ালি প্রযোজনা করছি আমি হুমায়ূন ফরিদ। আর এতে অভিনয় করেছেন: রাশনা শারমিন কেমি, তাহমিদ আরেফিন হক, তারিক আনাম খান, মিলি বাশার, মামুনুর রশীদ, রহমত আলী, গাজী রাকায়েত, শতাব্দী ওয়াদুদ, লারা লোটাস, এহসানুর রহমান, ইকবাল, কাজী নওশাবা, রাজীব সালেহীন, শর্মীমালা, হুমায়ূন ফরিদ, মৃণাল দত্ত, আনন্দ খালেদ, তাহমিনা মোনা, আদনান বাঙালী, মিজানুর রহমান, নমিতা দাস, মীর বরকত, অনিক খান, হোসনে আরা, রিয়াদ, আরিফ, মোহন ও আরও অনেকে। এই সিনেমায় অন্যদের সাথে মহাত্মা ভ্যালেরি আন টেইলর নিজেও অভিনয় করেছেন!

আমাদের ‘সি দ্যা পার্সন’ এর গল্পে দেখা যায় ফরিদা আহমেদ নামের প্রধান নারী চরিত্রটি সেরিব্রাল পালসি-তে আক্রান্ত। সে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মেধাবী হলেও শারীরিকভাবে অক্ষম, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। মানুষ তাকে কটু কথা শোনায়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তবুও সে দমে যায় না। সে সেরিব্রাল পালসি-তে আক্রান্ত সব মানুষের মানবিক অধিকারটুকু অর্জনের জন্য লড়াই করে। এ কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ফিরোজ মালমুদ। সে কাজ করে পথশিশুদের নিয়ে। একসাথে পথ চলতে চলতে ফিরোজ ও ফরিদার মধ্যে একটি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের সেই সম্পর্কে বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় ফিরোজের বড়লোক বাবা মিস্টার মালমুদ। এই যে ‘মানুষটিকে দেখ ‘সি দ্যা পার্সন’, মানে শারীরিক কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভেতরের আসল মানুষটিকে দেখ এটাই আমাদের সিনেমার মূল মেসেজ।

মানুষের ভেতরের মানুষটিকে দেখানোর সেই অসাধ্য কাজটি ভিজ্যুয়ালি খুব সাফল্যজনকভাবে করেছেন নির্মাতা গাজী রাকায়েত। এই সিনেমায় গত ১৫ মাস ধরে আমি তাঁর সাথে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করেছি এবং প্রতিদিনই নতুন এক রাকায়েত ভাইকে আবিষ্কার করেছি। আমার খুঁজে পাওয়া নতুন রাকায়েত ভাই জনপ্রিয় অভিনেতা গাজী রাকায়েত নন, দুই সিনেমায় অনেকগুলি ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পাওয়া নির্মাতা গাজী রাকায়েত নন, দক্ষ সংগঠক কিংবা স্বনামধন্য শিক্ষক গাজী রাকায়েত নন বরং সারাক্ষণ মহান আল্লাহর তায়ালার বন্দনায় মশগুল থাকা একজন সাধারণ মানুষ। এখন তিনি সপ্তাহে কমপক্ষে ২ দিন রোজা রাখেন। দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। এ এক অবিশ্বাস্য রাকায়েত ভাই!

বুয়েট থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসা রাকায়েত ভাই কিংবা দেশ-বিদেশের বড় হোটেলের বারগুলিতে আড্ডা মারা রাকায়েত ভাইয়ের সাথে বর্তমান রাকায়েত ভাইয়ের যেন কোন মিলই নেই! যে মানুষটি এক সময় রাতদিন পড়াশুনা করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করার জন্য, সেই মানুষটিই এখন রাত-দিন গবেষণা করেন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য। আমি নিশ্চিত যে তাঁর ‘দ্যা ম্যাথমেটিক্যাল বিউটি অব আল কোরান’ প্রকাশিত হলে সারাদেশে তা হৈচৈ ফেলে দিবে! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাস্তবতা এই যে গাজী রাকায়েত ভাই এখন শুটিং ফ্লোরে এসে সকালটা শুরু করেন সবাইকে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া-প্রার্থনা করে। তিনি এখন এ্যালকোহল-তো দূরের কথা, বিড়ি-সিগারেটও খান না। শুটিংয়ের বাইরে শুধু সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরিধান করেন। তিনি এখন আসলে একজন দার্শনিকের জীবন যাপন করেন। রাকায়েত ভাইয়ের সাথে ‘মানুষটিকে দেখ ‘সি দ্যা পার্সন’ সিনেমাটা করতে যেয়ে আমার ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর কিছু স্পিরিচুয়াল ইমপ্যাক্ট পড়েছে। আমি কোনদিনই খুব রিলিজিয়াস ছিলাম না, কিন্তু রাকায়েত ভাইকে দেখে এখন আমিও সপ্তাহে ১ দিন রোজা রাখি। চেষ্টা করছি এটাকে সপ্তাহে ২ দিনে উন্নীত করতে। গাজী রাকায়েত ভাইয়ের ২টি কথা আমি আমার ছাত্রদেরকে প্রায়ই বলি। তিনি বলেন, ‘যে দেশে ২০ কোটি মানুষ, সেই দেশে গল্পের অভাব নাই’। এছাড়া, তিনি আমাদেরকে আর একটি কথাও বলেন, ‘তুমি কাউকে সন্মান করতে না পারলেও অসন্মান কইরো না’। আমার ওয়াইফ মৌ আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘রাকায়েত ভাইয়ের সাথে কাজ করে আপনি কেমন ফিল করেন?’ আমি তাকে এক কথায় উত্তর দেই, ‘আই ফিল লাইক ওয়ার্কিং উইথ এ সেইন্ট’!

হুমায়ূন ফরিদ, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও শিক্ষক।

আরো পড়ুন