বিজয় দিবস : স্মৃতি, সংগ্রাম ও কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্ন

আবু তালেব সিদ্দিকী

by sondeshbd.com
23 views

আজ ১৬ ডিসেম্বর—বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ অর্জন করে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সে কারণেই আমরা প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধা ও আড়ম্বরের সঙ্গে দিনটি পালন করে থাকি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক জনাকীর্ণ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণ ছিল বাঙালির স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা ও চূড়ান্ত প্রস্তুতির আহ্বান।

এর অল্প কিছুদিন পর, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় নৃশংস গণহত্যা চালায়। নিরস্ত্র মানুষ নির্বিচারে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই এ দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ যে এমন পরিস্থিতি আসন্ন—তা আঁচ করেছিল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে জনসাধারণকে সংগঠিত করতে শুরু করে। অস্ত্রের অভাবে সামরিক প্রশিক্ষণের চেয়ে তখন বেশি গুরুত্ব পায় পাকিস্তানি শাসন ও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ।

ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার বাইরে দেশের নানা স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। পরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার মানবিক কারণে এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়।

দেশের অভ্যন্তরে যারা সংগঠিত হচ্ছিল—বিশেষ করে তরুণ সমাজ—তারা পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার মুখে একপর্যায়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এবং গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। সে সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বড় একটি অংশ ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশের ভেতরে এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। ভারত সরকারের সহযোগিতায় গোপনে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় এবং গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ জোরদার হয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)-এর অনেক সদস্যও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ধারাবাহিক গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের শেষভাগে ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে এবং অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

এই দিনটিই আমাদের বিজয় দিবস।
তবে ইতিহাসের একটি দিক প্রায়ই আলোচনায় আসে—যুদ্ধের সূচনা ও দীর্ঘ লড়াই ছিল মূলত মুক্তিবাহিনীর হাতেই। অথচ আত্মসমর্পণটি গ্রহণ করা হয় যৌথ বাহিনীর কাছে, যেখানে মুক্তিবাহিনীর সরাসরি উপস্থিতি ছিল ভীষণ সীমিত। অনেকের কাছেই এটি যেন বিজয়ের কৃতিত্ব ভাগ করে নেওয়ার এক বাস্তবতা বলে মনে হয়। তবু ইতিহাসের চূড়ান্ত সত্য হলো—এই যুদ্ধ বাঙালির রক্তে, ত্যাগে ও প্রতিরোধে জেতা যুদ্ধ। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, একটি নতুন জাতীয় পতাকা, আর একটি স্বাধীন সার্বোভম জাতিসত্তা।
এই বিজয় আমাদের অহংকার, আমাদের দায়বদ্ধতা—এবং ইতিহাসকে জানার ও প্রশ্ন করার অধিকারও আমাদেরই।

লেখক:আবু তালেব সিদ্দিকী, কবি, উপন্যাসিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

আরো পড়ুন