চন্দ্রদাহ পর্ব – ৬

জিল্লু র রহমান শুভ্র

by sondeshbd.com
343 views

২৬শে মার্চ ছিল নিত্যানন্দ চ্যাটার্জী’র জন্মদিন। জন্মদিন পালন বাঙালিদের জন্য
আবশ্যিক নয়, তবে চ্যাটার্জী পরিবারের জন্য ভিন্ন কথা। মি. চ্যাটার্জী’র পিতামহ যখন
ব্রিটিশদের সংস্পর্শে আসেন, তখন থেকেই জন্মদিন পালনের আচার-অনুষ্ঠান চালু করেন
তিনি। তখন তার মনে হয়েছিল ধর্মীয় উৎসবের মতো এই উৎসবও সবাইকে একই
ছাতার নিচে নিয়ে আসে।
বাবার জন্মদিন মানেই সাবিত্রী ও রাত্রি’র কাছে বিশেষ দিন। একমাত্র আপন অর্থাৎ
পরিবারের কেউ মারা না গেলে তারা এই দিনটি পালন করবেই। বাবার জন্মদিন পালন
করার বিষয়ে অদ্ভুত ক্রেজি তারা। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। ফিবছর, তারা এটি
বড়সড় উপায়ে পালন করে থাকে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা হেতু, সর্বাগ্রে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার কারণে কাঙ্ক্ষিত
জন্মদিনের পার্টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল; কারণ, মি. চ্যাটার্জী এবার নিজেই চাচ্ছিলেন
না। শুধু তাই নয় এ বিষয়ে কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাবিত্রী ও রাত্রি
হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। তাদের কঠোর পীড়াপীড়ি ও অনুরোধে মি. চ্যাটার্জী অবশেষে
সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠানটি করতে রাজি হলেন। তখন দু’বোন যুগপৎ আনন্দিত ও
বিস্মিত। প্রতিবছর, তারা তাদের বাবাকে বর্ণিল এবং আকর্ষণীয় উপহার দেয় এবং সেই
উপহারগুলো কেনার জন্য তাদের রোমাঞ্চকর প্রস্তুতি থাকে। এবার সে-রকম কিছু না।
দিনটি ছিল বিষণ্ন, হতাশার এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার, বিশেষত সাবিত্রী’র
কাছে। সেদিন তাকে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। কাজেই, কিছু কেনার সময়
পায়নি কিংবা কেনার মুডে ছিল না সে। হঠাৎ ভাবল, যদিও সে স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল,
চটজলদি কিছু কিনে আনা যাক। চিন্তায় পড়ল কোথায় কিনবে? নিউমার্কেট বন্ধ ছিল।
চতুরতার সাথে, রাত্রিকে সঙ্গে নিয়ে চকবাজারে দুর্লভ কিন্তু মূল্যবান নয় এমন জিনিস
বিক্রি হত এরকম একটি দোকানে গেল সে।
দোকানটি চালাত একজন খর্বকায় মানুষ। নিলামে অনেক জিনিস কিনত সে।
উদ্ভাসিত হাসিতে নিজেকে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা ও খদ্দের মনোরঞ্জনে অতুলনীয় বলে তাদের
মনে দাগ কাটার চেষ্টা করছিল।
“বেঁটে বলে যতই টিটকারি মারো আমি সহজে রাগিনা। আর এটাও জোর গলায়
বলতে পারি এই শহরের কেউই আমার মতো সস্তায় তার পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না।
শুধুমাত্র আমিই বিক্রি করছি এইসব সেকেন্ড হ্যান্ড সস্তা রংচংয়ে পণ্য।”
দোকানের পণ্যগুলো ছড়ানো-ছিটানো। তারা কী কিনবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে, অবশেষে, সাবিত্রী আঠারো শতকের পাটেক ফিলিপের তৈরি
কব্জি-ঘড়ি বেছে নিল। আর রাত্রি ব্যাকড্রপ না জেনেই ডার্বি এবং জোয়ানের রেপ্লিকা
পছন্দ করল, কেবল তার কাছে ভালোলাগার জন্য। যাই হোক না কেন, তারা তাদের
পছন্দসই জিনিস দুটি কিনতে পেরে বেশ উত্তেজিত—যা ছিল তাদের ক্রয় ক্ষমতার
ভেতর।
রাত তার কালো পোশাক পরে সদম্ভে উপস্থিত। রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো সেই
পোশাকের ঝলমলে জরিনগুল। তারা বাড়িতে ফিরছিল, রাস্তার মধ্যে রাত্রি হঠাৎ দিদিকে
জিজ্ঞাসা করল, “দিদি, দয়া করে আমাকে বলো তো ডার্বি ও জোয়ান কে ছিলেন?”
বলল সে, “ডার্বি এবং জোয়ান আদর্শ স্থানীয় এক প্রবীণ দম্পতি। হেনরি উডফল
১৭৩৫ সালে ‘দ্য জেন্টলম্যান’ ম্যাগাজিনে তাদেরকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন—

Old Darby, with Joan by his side

You’ve often regarded with wonder.

He’s dropsical, she is sore-eyed

Yet they’re ever uneasy asunder.

এরপর, তাদের উপর প্রচুর সংখ্যক কবিতা রচনা করেছিলেন খুব পরিচিত এবং অচেনা
কবিরা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতারা চলচ্চিত্র পর্যন্ত তৈরি করেছিলেন।”
রাত্রি খুশি হয়ে বলল, “আমাদের বাবা হতে পারেন ডার্বি এবং মা জোয়ান, তাই
না?” তারপর সে দিদি’র দিকে তাকাল।
হঠাৎ সাবিত্রীকে আঘাত করল এক ঝড়ো বাতাস। তার মসৃণ চুল বাতাসে সাঁতার
কাটতে ভেসে উঠল। সারাদিন পর, সবেমাত্র আনন্দ তার মনকে স্পর্শ করল এবং অদ্ভুত
উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে দিল।
গাঢ় লাল ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি ফুটিয়ে তুলে, বলল সে, “তুলনা করা যেতে পারে, তবে
একাধিক সমস্যা। সমস্যাগুলো কী? সমস্যাগুলো হলো তাদের বয়সের পার্থক্য। বাবা
মা তাদের সমবয়সী নয় এবং এখন অবধি ষাট পেরোয়নি। এটি প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয়
সমস্যা, তারা অবসর সময় কাটাচ্ছে না। তবে চরম সত্য, তারা ডার্বি এবং জোয়ানের
মতো বুড়ো হতে চলেছে।”
হাঁটতে হাঁটতে তারা ভেঙে পড়া একটি পুরনো বাড়ির সামনের সরু গলিতে যখন
পৌঁছুল, হঠাৎ উচ্ছৃঙ্খল কতিপয় যুবক—যারা ধর্মান্ধ এবং পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক,
দু’বোনকে একসাথে দেখে চিৎকার করে উঠল—ধর! ধর শালীদের! ভারতের এজেন্ট!
সম্ভবত, তারা কোনো না কোনোভাবে তাদের চিনতে পেরেছিল। পৌত্তলিকদের
বিরুদ্ধে গভীর-শেকড়ে প্রোথিত বিদ্বেষ ও হিংসে দ্বারা যুবকরা তাড়িত ছিল বলে তাদেরকে
তাড়া করল।
ভয়ে দৌডাতে শুরু করল তারা। তবে জায়গাটি ছিল আবর্জনায় ভরা, স্যাঁতসেঁতে,
ছায়াময় এবং বেকারি চিমনি থেকে তৈরি ঝুলকালিতে আচ্ছন্ন। এরকম শোচনীয় নোংরা
পরিবেশ তাদেরকে বিভ্রান্ত করছিল। কোনদিকে পালাবে, ঠাহর করতে পারছিল না তারা।
ইতস্তত করতে করতেই যুবকদের হাতে ধরা পড়ল। যুবকদের চোখ ছিল সাবিত্রী’র
ভ্যানিটি ব্যাগের উপর। যুবকদের মধ্যে একজন, বেপরোয়া দুর্বৃত্তের মতো বলল, “এই
সুন্দরী, তোমার ব্যাগ এখন আমাদের!”
সাবিত্রী’র চোখে জল সাঁতার কাটছিল। বলল সে, কাঁদতে কাঁদতে, “প্লিজ, ডোন্ট
টেক ইট!”
দুর্বৃত্তটি তার পকেট থেকে ধারালো ছোরা বের করে শূন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“ব্যাগটা কি তোমার জীবনের চেয়ে প্রিয়? তোমার জীবনকে ভালোবাসো না? যদি না
বাসো তবে তা আলাদা কথা। এ জাতীয় মানুষের জন্য আমার ছোরাই যথেষ্ট। এটি
ছোট তবে কার্যকর।’’ দু’বোনকে ভালো করে দেখার পর, ধর্মকে টেনে এনে, ”বাঙালি
হলেও তোমরা দু’জনেই হিন্দু। তেল এবং পানি যেমন একসাথে মিশে না, তেমনি হিন্দু
ও মুসলমান।”
আরেকজন বলল, জলদগম্ভীর কণ্ঠে, “বলতে গেলে, সমস্ত হিন্দু পাকিস্তানের
বিপক্ষে। তারা এই দেশ ভাগ করতে চায় তাদের নিজেদের স্বার্থে। প্রতিটি হিন্দু বা হিন্দুর
সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করি। হিন্দুদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আমার
রক্তে, আমার শিরায় এবং আমার চোখে। সুতরাং, যদি আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো
তোমাকে শ্মশানে পাঠাব এবং তোমার ছোট বোনকে ওই যে নির্মাণাধীন বাড়িটা দেখছ
সেখানে আটকে রাখব। সারারাত যাত্রাপার্টি চালাব। বলো, এখন কী চাও?”
সাবিত্রী এবং রাত্রি দুজনেই এমন সাধারণ পোশাকে ছিল, ভয় ও ভীতির আস্ফালন
তাদের চোখে-মুখে সহজেই ধরা পড়ল। তারা ভয়ে জড়সড়। দুর্বৃত্তদের কটুকাটব্যে ভরা
কথাবার্তায় তাদের উদ্দীপনা একেবারে ছাইকাদা। সেই সুযোগে, তারা ব্যাগটি ছিনিয়ে
নিল চোখের পলকে, এবং তারপর ঘৃণার থুথু ছিটিয়ে পালিয়ে গেল অন্ধকারে।
তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো না। বাড়িতে ফিরল খালি হাতে এবং বিধ¦স্ত হয়ে।
কাউকে না জানিয়ে তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দিল। মজার বিষয়, তারা তাদের বাবা-মাকে
পর্যন্ত ঘটনাটি ঘুণাক্ষরে জানতে দিল না। তবে মানসিক আঘাতে যেমন পরিবর্তন লক্ষ
করা যায় তেমনি তাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে লাগল—অদ্ভুত অদ্ভুত পরিবর্তন।
জন্মদিনের পার্টিটি ছোট আকারের এবং অনানুষ্ঠানিক ছিল, এ কারণেই নিকটতম
প্রতিবেশীরা আসতে শুরু করেছিল। দূরের আত্মীয়স্বজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অতিথিদের জন্য বসার ব্যবস্থা ছিল হলরুমে। জন্মদিনের কেক কাটতে ফ্লোরের মাঝখানে
একটি বড়সড় টেবিল রাখা হয়েছিল, এবং অবশ্যই, একটি অকেজো ঝাড়বাতির নিচে।
অতিথিদের একত্রিত হওয়ার পর পার্টি পরস্পরের পানপাত্রে ঠোকাঠুকি করে শুরু হলো।
সাবিত্রী এবং রাত্রি, অদ্ভুত ধরনের, যা আগে তারা পরেনি, অনুষ্ঠানের পোশাক পরে
তাদের ঘরে অবস্থান করছিল; একে অপরের দিকে ইশারা ছুঁড়ে দিল।
হলরুমে এসে কোনো অনুরোধ বা কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অতিথিদের সামনে
উদ্ভট নাচ শুরু করল তারা। অতিথিরা অবাক, কিন্তু তারা ভুল করল না তাদের হাততালি
দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে। তাদের মধ্যে একজন, গুণ্ডাদের মতো মন্তব্য করল, “Golly! এটি একটি ফালতু নাচ; তবে পছন্দ করছি!”
আরেকজন মন্তব্য করল, “দুর্দান্ত পারফরম্যান্স!”
অতিথিদের সামনে মেয়েরা কেন নাচছে, মিসেস চ্যাটার্জী যেমন বিস্মিত তেমনি
হতবাক। নাচ বন্ধ করতে ধমক দিলেন তাদের, কিন্তু তারা মাকে পাত্তা দিল না। তারা
তাদের নাচ চালিয়ে গেল।
মি. চ্যাটার্জী একটু দূরে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, কিন্তু তার মেয়েদের
‘উদ্ভট নাচ’ তার চোখ এড়ায়নি। এটা তাকে বিব্রত করছিল। ভেতরে ভেতরে তিনি ক্ষুব্ধ
হচ্ছিলেন, আলোচনা না চালিয়ে, মেয়েদের কাছে এলেন এবং তার স্ত্রী’র মতো করে
নয়, একেবারে সামরিক অফিসারের কায়দায় আদেশ করলেন তাদের নাচ থামাতে।
কিন্তু মেয়েরা তার গর্জনকে অসার প্রমাণ করে নাচ অব্যাহত রাখল, আগের মতো। তিনি
যারপর নেই বিস্মিত হচ্ছিলেন এই ভেবে মেয়েরা কেন এমন করছে? সঠিক কারণ খুঁজে
পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু যখন তারা, অবশেষে, ক্লান্ত হয়ে নাচ বন্ধ করে দিয়ে দর্শকদের
অনুভূতি জানার জন্য অপেক্ষা করছিল, অতিথিদের মতো তিনিও তাদের অভিনন্দন
জানালেন।
সাবিত্রী এবং রাত্রি হলরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলানোর জন্য তাদের বেডরুমে
গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা তাদের অনুসরণ করলেন। ঘরে ঢোকার পর তারা দু’ভাগে
বিভক্ত হলেন। বাবা সাবিত্রী’র কাছে গেলেন এবং মা রাত্রি’র কাছে।
যদিও মি. চ্যাটার্জী সবার মতো মেয়েদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, কিন্তু তার
ক্রোধের পারদ এতটুকু নামেনি। উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “নাচছিলে কেন? তুমি
কি নর্তকী? ভাবতে পারছি না, ছি!”
সাবিত্রী কোনো আপত্তি না করে বরং তার মুখ গম্ভীর করে তুলল এবং অটলভাবে
দাঁড়িয়ে রইল।
তার এড়িয়ে যাওয়া আচরণ তাকে বিরক্ত করল। গর্জন করলেন, যাকে বলে বাঘের
গর্জন, “আমি তোমার বাবা! জানার অধিকার আমার আছে! উত্তর দাও! তুমি, সম্ভবত,
ধনীদের সাথে মাখামাখি করতে চাও! এটা তাদের কালচার! আমাদের নয়। সোমত্ত মেয়ে
না হলে—” বলতে বলতে তিনি যেন হাঁপিয়ে উঠলেন।
একটু পর স্ত্রী’র দিকে তাকালেন। বিস্মিত গলায় স্বামীকে জানালেন রাত্রিও সাবিত্রী’র
মতো কোনো উত্তর দিচ্ছে না। রাত্রি যেন বধির ও বোবার মতো আচরণ করছিল। কোনো
ফয়সালা না পেয়ে তারা একে অপরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। ”ব্যাপারটা কী?”
এই জাতীয় সংশয় যখন তাদের চোখে ডুবসাঁতার কাটছিল, ঠিক তখনই তাদের ডোরবেল
বেজে উঠল।
মি. চ্যাটার্জী দরজা খুলতে গেলেন।
কালো আলখাল্লা পরিহিত এক অদ্ভুত বৃদ্ধ লোক দরজার সামনে ছায়ামূর্তির মতো
দাঁড়িয়ে, ঝাপসা অন্ধকারে তাকে পরিষ্কার চেনা যাচ্ছিল না। এক রোমাঞ্চকর ভীতি তাকে
আচ্ছন্ন করল। ঘাবড়ে গিয়ে, কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি, “কে আপনি? কী চান
এখানে?”
অদ্ভুত বৃদ্ধ লোকটি তার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেন, তবে ভীতি প্রদর্শনের রহস্যময়
ছাপ ফুটে উঠল তার অদ্ভুত হাসিতে। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি মি. চ্যাটার্জী?
নৌকার গোঁড়া সমর্থক?”
“হ্যাঁ, সন্দেহ নেই,” তিনি, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার পর, বাঁকা দৃষ্টিতে বললেন।
এবং আরো যোগ করলেন, “নৌকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক। মনে করি এটি
একমাত্র প্রতীকেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, এটি আমাদের
অস্তিত্বের প্রতীক এবং এটি বাঙালির হাজার বছরের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধের প্রতীক।
এটি অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য বাতিঘর!”
অদ্ভুত মানুষটি কোনো তর্ক না করে, একটি হলুদ খাম তার হাতে তুলে দিয়ে
তারপর ব্যস্ত মানুষের মতো সটকে পড়লেন।
তিনি মেয়েদের কাছে ফিরে এলেন। চিরকুট বা চিঠিটি পড়ার জন্য খামটি খুললেন।
এটি কোনো চিরকুট ছিল না, দীর্ঘ চিঠি—তিন প্যারাগ্রাফে বিভক্ত। চোখ পিটপিট না
করে, রুদ্ধশ্বাসে পড়তে শুরু করলেন—
হ্যালো মি.
আমার ছদ্মনাম নাম SNAKE OF HOLE। নাম শুনে নিশ্চয় হাঁটুর
কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে আমার আসল নাম এই নামের নিচে চাপা
পড়ে আছে। এই নামেই আমি বিখ্যাত বা কুখ্যাত। এজন্য আমার কোনো
অনুশোচনা নেই। তবে আপনার জানা উচিত কেন এই নাম? আর কেনই বা
আমি হিন্দু-বিদ্বেষী? দিবালোকের মতো স্পষ্ট একদা আমার বাবা-মা হিন্দু
বাড়িওয়ালার হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। এটা ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের
ভারত ভাগের ঠিক আগে আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মোড়কে—যখন আমার
বাবা-মা কলকাতায় থাকতেন।
আমি সবে জন্মগ্রহণ করেছি। বয়স ছিল বড়জোর দু-তিন মাস। এটি
অবাক করা বিষয় হলেও সত্য, বিভাজন সম্পর্কে আমার পল্লবগ্রাহী ধারণা
রয়েছে। পরে শুনেছি, উচ্ছৃঙ্খল হিন্দু জনতা নির্দোষ মুসলমানদের উপর
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং নির্বিচারে হত্যা করেছিল মুসলমানদের। আমাকে
বাঁচাতে সমস্ত সম্পত্তি (স্থাবর-অস্থাবর) ফেলে দাদু আমাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা
থেকে পালিয়েছিলেন। পরে দাদুর কাছে শুনেছি, তিনি যখন কলকাতা থেকে
পালাচ্ছিলেন, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তার সাথে কোনো ছাতা বা
বর্ষাতি ছিল না। আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলাম তো যাচ্ছিলামই। বৃষ্টি থেকে
বাঁচানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কিন্তু পারেননি। সেই সময় আমি
ছিলাম মাত্র দুই বা তিন মাসের শিশু। একরাতের পরে, দীর্ঘ সময় ভেজার
কারণে আমার জ্বর এসেছিল। জ্বর বাড়ছিল তো বাড়ছিলই। শূন্য হাতে তিনি
কলকাতা ছেড়ে এসেছিলেন। আমার চিকিৎসার জন্য অগত্যা তাকে তার
জুতো ও পরনের কাপড় বিক্রি করতে হয়েছিল। এই ছিল আমার জীবন।
তিনদিন দু’রাত পর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি ঢাকায় পৌঁছেন। সেই
থেকে আমি এখানে আছি এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র অনুগ্রহে বহাল-তবিয়তে
আছি। বড় হওয়ার পর থেকে মাউন্টব্যাটেন, গান্ধী, নেহেরু এবং জিন্নাহকে
তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখি। তাদের স্বার্থপরতা এবং বিপথগামী রাজনীতির
কারণে আমি আমার পিতা-মাতাকে হারিয়েছি। শুধু তাই নয়, জানি না পর্যন্ত
তারা দেখতে কেমন ছিলেন? তারা মানুষ ছিলেন না প্রাণী? এটি অত্যন্ত
বেদনাদায়ক, তাদের সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এই পৃথিবীর নিষ্ঠুর
মানুষদের কারণে! বড় হওয়ার পর থেকে ঘৃণা করি মানুষ এবং কাউকে হত্যা
করতে আমার হাত একটুও কাঁপে না। আমাকে জল্লাদ বা হিংস্র পশু ভাবতে
পারেন। হ্যাঁ, আমি জল্লাদ! হ্যাঁ, আমি হিংস্র পশু! আমি এত ভয়ঙ্কর যে
হাসতে হাসতে মানুষের রক্ত পান করতে পারি! তবে কেন আমি জল্লাদ? কেন
আমি হিংস্র পশু? সেই সমস্ত বর্বর লোকদের কারণে যারা আমার মা-বাবাকে
হত্যা করেছে! মায়ের স্তন থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে! এবং মাকেও
বঞ্চিত করেছে তার স্তন্যদানের আনন্দ থেকে। যে সন্তান তার মায়ের দুধ
পান করতে পারেনি তার চেয়ে বড় হতভাগা এই দুনিয়াতে আর কে আছে!
বাবার ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত করেছে! বাবা বেঁচে থাকলে আমিও আপনার
সন্তানের মতো বাবার কাঁধে পা ছড়িয়ে বসে কোথাও ঘুরতে যেতে পারতাম।
বাবা ক্লান্ত হয়ে একসময় মাটিতে ধপাস করে রাখতেন। বিরক্ত হয়ে হয়ত
বলতেন, পাত্থর একটা!
যারা আমার সোনালি শৈশব কেড়ে নিয়েছে ধিক তাদের! আমি এখন
পাকিস্তানের তল্পিদার। মুজিবকে ঘৃণা করি; কারণ, তিনি পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টা
করছেন। তিনিও মাউন্টব্যাটেন, গান্ধী, নেহেরু এবং জিন্নাহ’র মতো পাপ
করছেন। উপনিবেশের নীল বিষে একসময় উপমহাদেশের অনেক সাধারণ
মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এবারও হারাবে। গণহত্যা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড মাথা
তুলে দাঁড়াবে। উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। এইদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের জালে
ভয়াবহভাবে আটকে যাবে। আমার মতো প্রচুর ছেলেমেয়ে তাদের বাবা
মাকে হারিয়ে ফেলবে। যাই হোক না কেন, আপনি ইতোমধ্যে জেনে গেছেন
যে, আমার নাম SNAKE OF HOLE। তাই বলে ভাববেন না আমি ইঁদুর,
বেড়াল, পোকামাকড় খাই। তবে আমি যখন গর্ত থেকে বেরিয়ে আসি তখন
হিন্দুদের ছোবল মারি। কারণ, তারা বিশ্বাসঘাতক মুজিবের পেছনে! মুজিব
মানে, আমি মনে করি, পথভ্রষ্ট এক বিশৃঙ্খল মানুষ। এবং সেই মানুষটির
বিশিষ্ট লেজ হওয়ার কারণে আপনি আমার টার্গেট। সাবধান! এটি আপনার
শেষ জন্মদিন। পাথুরে ভূখণ্ডে যেমন বৃক্ষ জন্মায় না তেমনি আমার হৃদয়ে
কারো জন্যে সহমর্মিতা জন্মাবে না। কালাহারি মরুভূমিতে ব্যাজার (Badger)
নামে এক দুর্ধর্ষ প্রাণী আছে সাপ যত বিষধরই হোক কিংবা লম্বা দেহের হোক
সামনে পেলে তাকে নুডলস খাওয়ার মতো খেয়ে ফেলে। আমিও সেই দুর্ধর্ষ
ব্যাজার। অতএব— SNAKE OF HOLE চিঠি শেষ করে তিনি দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন। তার স্ত্রী তার কাছে এসে আশ্চর্য
হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে গো?”
ঠিক হতবাক হয়ে তিনি চিঠিটি স্ত্রী’র হাতে দিয়ে এটি পড়ার ইঙ্গিত দিলেন। ইঙ্গিত
পেয়ে তিনি চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। অতঃপর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
চিঠিটা মুঠোয় নিয়ে উন্মত্ত ক্রোধে চোখ পাকিয়ে দলা পাকালেন, কয়েক সেকেন্ড পর
শূন্যে তাকিয়ে বললেন, “এসব হচ্ছেটা কী?”
কিছুক্ষণের জন্য মি. চ্যাটার্জী কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন, নিজেকে ফিরে
পাওয়ার পর বললেন, “জানি না! কার এত সাহস! এই জন্মভিটে আমার, আমাদের—
কোনো বাস্তত্মু ঘুঘুর নয়।” বলতে বলতে গলা ধরে এলে তিনি আবারো চুপ হয়ে গেলেন।
মিসেস চ্যাটার্জী বিষম চিন্তায় পড়লেন। খানিকটা দূরে সাবিত্রী ও রাত্রি দাঁড়িয়েছিল,
চিঠি’র মেজাজ অনুধাবন করে, তারা এগিয়ে এল মায়ের কাছে। যে-ঘটনাটি এপর্যন্ত
গোপন করে রেখেছিল তারা আজ তা মায়ের সামনে প্রকাশ করল। ঘটনাটি শুনে মিসেস
চ্যাটার্জী অবাক হয়ে গেলেন, “বলো কী! এতদিন গোপন রেখেছিলে কেন?” বারবার
জিজ্ঞাসা করলেন। অনেক কণ্ঠস্বর একত্রে প্রশ্নের ঝড় হয়ে আসছিল কোনো অদৃশ্য জায়গা
থেকে, এবং দু’বোন সেই ঝড়ে যেন লণ্ডভণ্ড। স্খলিত কণ্ঠে বলল সাবিত্রী, “সেই কুৎসিত
ঘটনাটি প্রকাশ করে আমরা বাবার শুভ জন্মদিনকে নষ্ট করতে চাইনি।”
“তোমরা চাওনি, ভালো!” মি. চ্যাটার্জী নীরবতা ভাঙলেন, “জন্মদিনের পার্টি বন্ধ
করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ হিসাবে বলতে পারি এই পার্টি আমার গলার কাঁটা হতে
চলেছে।”
“হায় ভগবান! তুমি বলছ কী?” মিসেস চ্যাটার্জী চমকে উঠলেন।
“ফলাফল যাই হোক না কেন, বাতিল না করে উপায় নেই,” মি. চ্যাটার্জী দৃঢ়স্বরে
বললেন।
“আমি একেবারে হতাশ,” মিসেস চ্যাটার্জী বললেন, “তুমি হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত
নিচ্ছ?”
“মাথায় মৃত্যুচিন্তা নিয়ে তুমি না পারবে গাইতে না পারবে নাচতে। অনুষ্ঠান চালিয়ে
যাওয়া নিজের সাথে এক ধরনের প্রতারণা, তাই নয়কি!” বললেন তিনি।
মিসেস চ্যাটার্জী মেয়েদের দিকে তাকালেন।
মেয়েরা বাবার সিদ্ধান্তে খুশি। তারা মুচকি মুচকি হাসছিল। তাদের চেহারায় ছিল
শান্ত এবং স্থির ভাব।
কপট রাগ দেখিয়ে তিনি মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এটি হাসির কোনো বিষয়
নয়। মান-সম্মানের বিষয়।”
মায়ের রাগ দূর করতে রাত্রি সহজকণ্ঠে বলল, “মা, আমাদের নিয়ে ভেবো না।
বাবাকে উপহার দেবার মতো আমাদের কাছে কিছুই নেই। সবটাই ওরা কেড়ে নিয়েছে।
সুতরাং, এই পার্টি চালিয়ে যেতে আমরাও আগ্রহী নই।”
মিসেস চ্যাটার্জী স্বামীকে পার্টি বাতিল করার পরামর্শ দিলেন, “তবে সাবধান! আমন্ত্রিত
অতিথিদের বিনয়ের সাথে বলো আমরা কেন পার্টি মাঝপথে বন্ধ করে দিচ্ছি। সত্য কথা
বলো। সত্য কথা বলতে অসুবিধা কোথায়?”
“কোনো অসুবিধা নেই,” বললেন মি. চ্যাটার্জী, “তবে সত্য সবসময় সমাধান দেয়
না, কখনো পীড়াদায়ক। যেমন আজ।”
হলঘরে এলেন তিনি। হাসি এবং প্রাণশক্তি তার মধ্যে অনুপস্থিত। খারাপ সংবাদে
জর্জরিত লোকের মতো গম্ভীর এবং সামঞ্জস্যহীন। যেন কাছের কেউ বজ্রপাতে মারা
গিয়েছে। আর এমন কথা প্রকাশ করতে তিনি বড্ড আড়ষ্ট।
প্রিয় বিজ্ঞ বন্ধুরা,
আসল বিষয়টি হলো আমি আপনাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনিবার্য কারণে আমরা
এখনই এই পার্টি বন্ধ করতে যাচ্ছি। এজন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত! আপনারা আমাকে
জিজ্ঞাসা করতে পারেন কারণ কী। কারণটি খুব ভীতিজনক এবং অস্বাভাবিক। আমাকে
মৃত্যু’র হুমকি দিয়ে কেউ একজন উড়ো চিঠি পাঠিয়েছে। এটি কোনো মামুলি বিষয় নয়।
মৃত্যুভয় মাথায় নিয়ে এই উত্তেজনার পার্টি কীভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব তা আপনারা
বুদ্ধিমত্তার সাথে অনুভব করুন। আমি আর আমার জন্মদিনের কেক কাটতে আগ্রহী নই।
অক্ষমতা আমার সামনে শিস দিচ্ছে। সন্দেহ নেই, এই দেশটি একটি মৃত্যু উপত্যকা
হতে চলেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কোনো একটি দল এই দেশে স্বাধীনতা চায় না।
তারা শেখ মুজিবকে সমর্থন করছে না এবং যেভাবেই হোক তারা অশান্তি তৈরি করতে
চায়। এইদেশ একসময় মুঘলদের এবং পরে ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এখন
পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। আমরা পরাধীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে
আসতে পারছি না। আমার অনিচ্ছুক পরামর্শ দ্রুত খাওয়া-দাওয়া করুন। আমাদের সঙ্গে
এতক্ষণ থাকবার জন্য ধন্যবাদ।
আচমকা ভয় অতিথিদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল ভয়ের সাগরে। তারা বাড়ির সদস্যদের চে’
বেশি ভয় পাচ্ছিল। পার্টি ছাড়তে, তারা হুড়োহুড়ি করল। শুধু একজন, চল্লিশের ওপর
বয়স এবং বিভিন্ন বিষয়ে ঋদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে কথা বলার জন্য দলচ্যুত
মানুষের মতো রয়ে গেলেন। তিনি মি. চ্যাটার্জীকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে বললেন,
“বার বার প্রশ্ন করে আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। যদি একটা প্রশ্নের উত্তর দেন।”
মি. চ্যাটার্জী যদিও গম্ভীর এবং মিতবাক, তবে প্রয়োজনীয় কথা বলতে কসুর করেন
না। ভদ্রলোকের বিনয়ী আচরণে সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে ভ্রুকুটি না করে বরং গভীর
আগ্রহ দেখালেন।
“দেখুন, আমি সক্রেটিস নই কিংবা রাজনীতি-বিশারদও নই। তবে বয়সের ভারে
অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়টা আমি ভালোভাবে দেখেছি।
বলতে পারেন সময় মানুষের বড় শিক্ষক।”
“আপনি মনে করেন কিনা শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম
হবেন?” ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমি মনে করি, হ্যাঁ, অবশ্যই! ভাষা আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের
আত্মা বাঙালির স্বাধিকার অর্জনে তার সঙ্গে আছেন। তাছাড়া, তার ৬ দফা ম্যাগনাকার্টা
বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা যেতে পারে।”
উচ্ছ্বল বক্তৃতার মতো আবার বললেন, “তবে কীভাবে, এটি একটি কঠিন প্রশ্ন,
তবে অবাস্তব নয়। আপনি অবশ্যই জানেন শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবনে চার
হাজার তিনশত চুরানব্বই দিন কারাবাস করেছেন, অন্য কথায় প্রায় বারো বছর। তার
মধ্যে সাতদিন তিনি যখন ব্রিটিশ আমলের ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তান আমলে বাকি চার
হাজার তিনশত সাতাশি দিন এবং সতেরো বার জেল খেটেছেন, এটা কি ভাবা যায়? যে
ব্যক্তি জীবনের প্রথম থেকেই নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন,
যে ব্যক্তি রাজনৈতিক ইস্যুতে বারো বছর কারাদণ্ড খাটতে পারেন এবং যিনি মানুষের জন্য
আত্মত্যাগ করতে পারেন, কেবলমাত্র তিনিই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন। এছাড়া,
তার দৈহিক এবং মানসিক শক্তি এতটাই প্রকট তাকে দেখলেই মনে হবে তিনি স্পষ্টভাবে
বক্তৃতাশীল, ব্যক্তিত্ববান এবং প্ররোচিত। সংগ্রাম ও লড়াই তার রক্তে। পূর্ব পাকিস্তানের
মানচিত্র তার নিজের তালুর মতোই বেশ পরিচিত এবং তিনি এদেশের মানুষের পালস
ভালোভাবে অনুভব করতে পারেন। অবাক ব্যাপার এই যে, বুদ্ধিজীবীরা বলেন তিনি
রাজনীতির দুর্দান্ত কবি। আমি কী বোঝাতে পেরেছি?”
ভদ্রলোক তার জবাবে খুশি হয়ে চলে গেলেন।
যখন বাড়িটা শান্ত হলো, তখন প্রায় মধ্যরাত। মি. চ্যাটার্জী সাবিত্রী’র ব্যাপারে গভীরভাবে
চিন্তা করলেন। অতঃপর মেয়েকে কাছে ডেকে বললেন, ”মনে হচ্ছে তুমি কোনো কারণে
চিন্তিত। কারণটা কী জানতে পারি?”
সাবিত্রী আড়ষ্ট হচ্ছিল। মেয়েকে স্বাভাবিক করার জন্য তিনি আবার বললেন,
“আনন্দের সাথে নিরানন্দকে গ্রহণ করো। যে-ব্যথা তোমার মনে ধিকিধিকি জ্বলছে, তা
যদি প্রকাশ না করো, এটা আরো বাড়বে। কোনো একদিন ভয়ঙ্কর আগুনে রূপ নেবে
এবং নিঃসন্দেহে তোমাকে পোড়াবে। কাজেই গোপন না করে আমাকে নির্ভয়ে বলো।”
“আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে গতরাত থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। তার হঠাৎ
নিরুদ্দেশ আমার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,” সাবিত্রী বলল কাঁদকাঁদ হয়ে।
মি. চ্যাটার্জী তার বন্ধুর নাম, ধর্ম এবং বাসস্থান সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তুলে
সহানুভূতির সুরে বললেন, “তোমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।”
এরপর তিনি দায়িত্বশীল পিতার মতো বললেন, “আমাকে বলতে পারো তুমি কোথায়
কোথায় তাকে খুঁজেছ?”
“ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পিজি,” উত্তর দিল সে।
“মিটফোর্ড হাসপাতাল?” তিনি মেয়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমি সেখানে যাইনি,” বলল সে, ক্ষীণস্বরে।
“ঢাকা উত্তপ্ত কেটলির মতো ফুটছে এবং বুদ্বুদ করছে। ক্রোধে ফেটে পড়ছে অসংখ্য
ছোট ছোট বুদ্বুদ। আমরা জানি না কী হবে? তুমি যদি যেতে চাও, কাল সকালে যেও।
তাকে খুঁজে পাবে আমরা এ ধরনের আশা করতে পারি,” বললেন তিনি, সান্ত্বনার সুরে।
তারপর তারা সবাই ঘুমাতে গেল।
এ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম এল না শুধু একজনের চোখে—তিনি হলেন মি.
চ্যাটার্জী। বালিশে মাথা রেখে এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছিলেন। শরীরের হাড়গুলোর
শুধু ক্ষয়ই হচ্ছিল, কিন্তু ঘুম? তিনি তটস্থ ছিলেন গতরাতের গণহত্যা ও SNAKE OF HOLE

-এর হুমকির কারণে। মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও এর সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে
জড়িত। উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে এ ধরনের হুমকি পাবেন ভাবতেও পারছিলেন
না তিনি। আঠারো শতকের আগে কিংবা পরে দস্যুরা কিংবা ঠগিরা এ ধরনের হুমকি
সম্বলিত পত্র পাঠিয়ে থাকলে থাকতেও পারেন। দুশ্চিন্তা তাড়া করলে তিনি বিছানা থেকে
উঠে বসলেন।
স্ত্রী’র দিকে তাকালেন পাঁশুটে দৃষ্টিতে। তিনি মড়ার মতো পড়ে আছেন। অসহায়
ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে থাকলেন, অতঃপর বিছানা থেকে নামলেন।
ঘরময় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার যেন দম বন্ধ করে ছিল। কোনো কিছু ভালোমতো ঠাহর
করা যাচ্ছিল না। গুটিগুটি পায়ে, রেডিও’র খোঁজ করলেন। রেডিওটা যেন লুকোচুরি
খেলছিল তার সঙ্গে, সহসা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। খোঁজাখুঁজির পর পেয়ে গেলেন। চুপিসারে
বারান্দায় এলেন তিনি।
বারান্দা থেকে আকাশের দৌরাত্ম্য টের পাওয়া যায়। দুদিন আগেও গলাকাটা
অন্ধকারে ছিল নক্ষত্রদের গাণিতিক প্রদর্শন, আজ সেখানে জ্যামিতিক উল্লম্ফন। তারা
যেন পরস্পরের সঙ্গে ঢলাঢলি করছিল। তাদের ঢলাঢলি বেশ ভালোই লাগছিল তার।
কিন্তু তার আগ্রহ রেডিও নিয়ে।
নিবিড় আগ্রহে কানের কাছে ধরলেন রেডিও, ছাড়লেন ভল্যুম নিয়ন্ত্রণ করে। ইইঈ
ঘঊডঝ-এর চাইতে অষষ ওহফরধ জধফরড় বেশি শোনেন তিনি; কারণ, শেখ মুজিব সম্পর্কে
বেশি বেশি খবর প্রচার করছিল তারা। All India Radio থেকে প্রচারিত একটা খবর হঠাৎ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
উত্তেজনার সাগরে।
সেখানে বারবার সম্প্রচার হচ্ছিল: আজ ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুর
ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোঘণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের এম এ হান্নান।
তার ভেতর উত্তেজনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ, তিনি মনে করেন বঙ্গবন্ধু
৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। তবুও দেশ ও দেশের বাইরে কিছু একটা
হচ্ছে, এরকম ভেবে নড়েচড়ে উঠলেন। রেডিও বন্ধ করে স্ত্রীকে ডাকতে এলেন, কিন্তু
মাতাল ঘুম তার স্ত্রীকে ছিনতাই করে নয় রীতিমতো ডাকাতি করে নিয়ে গেছে তার নিজস্ব
ডেরায়। কয়েকবার ডাকলেন, বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে ঠেললেন, তাতেও সাড়া মিলল না।
এবার সাবিত্রীকে ডাকতে এলেন। যে-মেয়ে কখনো নাক ডাকত না, সেই মেয়ে হঠাৎ
এত জোরে নাক ডাকছিল তাকে ডাকার সাহস করলেন না। এরপর রাত্রি’র শিয়রে এসে
দাঁড়ালেন। ঘুমের মধ্যে রাত্রি’র কাপড়চোপড়ের বেসামাল অবস্থা তাকে আরো নাজুক
পরিস্থিতিতে ফেলল। ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ এরকম ভাবে তিনি তার ঘরে ফিরে
এলেন। “মূর্খদের কাছে স্বাধীনতার কী ভ্যালু আছে! কী হবে অশ্বমেধের গল্প শুনিয়ে?”
বিরক্তির সুরে কথাগুলো বলে স্ত্রী’র পাশে শুয়ে পড়লেন। কোথাও থেকে ভেসে আসছিল
ভিয়োলার ভারাক্রান্ত সুর। সুরের স্রোতে ডুবে গেলেন তিনি। (চলবে)

 

আরো পড়ুন