কীর্তি মানের মৃত্যু নাই । জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন একজন, মৃত্যুর পর হয়ে গেলেন ১৮ কোটি জনগণের। শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি জুলাই গণ অভ্যুত্থান এর অন্যতম যোদ্ধা, তাঁর বিষয়ে জেনেছি বেশ কিছুদিন আগে। তাঁর বিষয়ে, তার কর্মকান্ডের বিষয়ে, তার দর্শণের বিষয়ে আমাদের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু তার সাহসিকতা, তার চিন্তা ও দর্শন আমাদের চিন্তার চেয়েও অনেক বিস্তর আর সাহসী তা বলায় বাহুল্য।
তোমাদের আর আমাদের পার্থক্য হবে জানাযার দিনে। – ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ)। আপনি আমি মানুষের নিকট কতটা ভালবাসার পাত্র, জনগনের হৃদয়ের গভীরে কতটা জায়গা করে নিতে পেরেছি তা প্রকাশ পায় বা পাবে আপনার আমার মৃত্যুর পর জানাজায় লোক সমাগমের মাধ্যমে।
আজ শনিবার (২০ ডিসেম্বর) ২০২৫ দুপুর আড়াইটার দিকে ওসমান হাদীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। খামারবাড়ি থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত পুরো এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। হাতে জাতীয় পতাকা আর মুখে স্লোগান নিয়ে আসা এই বিশাল জনস্রোত সামাল দিতে এবং ১৬টি প্রবেশপথ দিয়ে মানুষকে ভেতরে ঢোকাতে হিমশিম খাচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ্ইটিই ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির সবচেয়ে বড় অর্জন।
তার বজ্র কন্ঠে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার আবৃতি আমাদের সুপ্ত হৃদয়কে জাগিয়ে তোলে। তার কাঁধে সন্তানকে বসিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণের দৃশ্য লক্ষ লক্ষ পিতা-মাতার হৃদয়ে বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে তোলে। তারই ভালবাসার নমুনা আজকের জাতীয় শোক দিবসের ঘোষণা।
আজকে ভোর থেকেই হাদিকে শেষবারের মতো দেখতে দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই জড়ো হন হাসপাতালের সামনে। দেশে আজ একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে। সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকছে।
আজ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির দাফনের সময় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তার সহপাঠী, স্বজন ও সহকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ওসমান হাদী সম্পর্কে আপনার-আমার অনেক তথ্যই অজানা। হাদি জেনারেল স্কুলে লেখাপড়া করেননি, তিনি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেছেন। দাখিল পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে টেলেন্ট ফুলে বৃত্তি পেয়েছেন।
তিনি দাখিল পরীক্ষায় মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রথম স্থান, আলিম পরীক্ষার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি মিশরের
আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, কিন্তু দেশাত্ববোধে উজ্জীবিত হাদী ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিক্যাল সায়েন্সে তিনি ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন।
তিনি ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিক্ষকতায় নিয়োগ প্রাপ্ত হন বলে জানা যায়। মাত্র কিছুদিন শিক্ষকতা করে তিনি দেশের টানে দেশে ফিরে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দেশের একটি ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষকতা করতেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।
হাদীর মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত। কখনোই কারো সাথে কটু ব্যবহার করতেন না। তিনি কোনদিন দুষ্টুমির ছলেও কোন দিন কারো মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা বলেননি।
তিনি সবসময় চাইতেন, বাঁচলে বীরের মত, মরলেও বীরের মত। এই চেতনাবোধ তিনি তার সকল বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, আজ বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি জনগনের হৃদয়েও সেই বাণী পৌছিয়ে দিয়ে চির বিদায় নিয়েছেন।
তিনি আল্লাহর এত পছন্দের মানুষ ছিলেন যে, তিনি যা চাইতেন আল্লাহপাক কখনো তাকে নিরাশ করতেন না। তিনি সবসময় বলতেন, রাজপথে মিছিলে আমার বুক বুলেটের আঘাতে ঝাজরা করে দেবে, আমি হাসতে হাসতে মহান আল্লাহ পাকের কাছে পৌঁছে যাব। এমন শহীদি মৃত্যু তিনি সবসময় চাইতেন। আল্লাহ পাকের কি অশেষ রহমত, তার চাওয়া মত শহীদি মৃত্যুই আল্লাহপাক তাকে দিয়ে চির অমর করে রেখে দিলেন। আমরা সকলেই শহীদ ওসমান হাদীর জন্য আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করি তিনি যেন তাকে বেহেশতের উচ্চ মাকাম দান করেন, আমীন।

