রাহাত ভালোবাসত নিশাতকে — গভীর, সত্য, নীরব এক ভালোবাসা।
তারা কখনও একে অপরকে “আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলেনি, কিন্তু চোখের ভাষা, একটুখানি হাসি, কিংবা নিরবতা—সবই বলে দিত অনুভবের গভীরতা।
একদিন খবর এলো—নিশাত বিয়ে করেছে।
রাহাত খবরটা শুনে যতটা না কষ্ট পেল, তার চেয়ে বেশি একটা প্রতিজ্ঞা করল নিজের ভেতর—
“এবার আমি নিজের মতো করে বাঁচব, নিজেকে তৈরি করব এমনভাবে—যাতে আমার অস্তিত্বই হয় আমার উত্তর।”
সে চাকরির প্রস্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দিনরাত পড়াশোনা, পরিশ্রম, আত্মসমর্পণ।
তার বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা, প্রেম, সব হারিয়ে গেল রাহাতের জীবনে।
তার জীবন হয়ে গেল কেবল একটি লক্ষ্য—নিজেকে প্রমাণ করা।
অবশেষে, কয়েক বছর পর, রাহাত পেয়ে গেল একটি নামী সরকারি চাকরি।
পোস্টিং হলো এক মফস্বল শহরে—চুপচাপ, নদীর ধারে, যেখানে সন্ধ্যায় বাতাসে ভেসে আসে মাটির গন্ধ।
প্রথম দিন অফিসে গিয়ে পরিচয় হলো এক তরুণী সহকর্মীর সঙ্গে—ঐশী।
বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসম্মানী, আর এক অদ্ভুত প্রাণশক্তিতে ভরা মেয়ে।
রাহাতের মনে হলো—এই মেয়েটি জীবনের প্রতি তার সেই হারানো বিশ্বাসটা ফিরিয়ে দিতে পারে।
প্রথমে ঐশীর আচরণে ছিল খানিকটা দূরত্ব।
রাহাতও ভাবল—“আমি কাউকে প্রমাণ করতে ভালোবাসব না, কেবল নিজেকে।”
কিন্তু সময়ের সাথে ঐশীর সরলতা, সাহস, আর মানুষের প্রতি মমতা ধীরে ধীরে রাহাতের হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায়, শহরের পুরনো সেতুতে দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, সূর্য ডুবছিল নদীর ওপারে।
রাহাত হঠাৎ বলল,
“ঐশী, আমি অনেক কিছু হারিয়েছি… কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমার পাশে থাকলে আমি নতুন করে শুরু করতে পারি।”
ঐশী মৃদু হেসে বলল,
“হারানো মানুষরা কখনও সত্যিই হারিয়ে যায় না, তারা অন্যের জীবনে ফিরে আসে—নতুন নামে, নতুন রূপে।”
কয়েক মাস পর তাদের বিয়ে হলো।
ছোট্ট এক অনুষ্ঠান, শহরের মানুষজন, কিছু সহকর্মী আর অনেক আন্তরিকতা।
বিবাহিত জীবন শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।
রাহাতের মনে ছিল আশার আলো—সে ভেবেছিল, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু বাস্তব জীবনে সব গল্পের মতো সহজ নয়।
ঐশীও কর্মজীবী, তারও স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, ক্লান্তি ছিল।
কাজের চাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা, আর সময়ের টানাপোড়েনে মাঝে মাঝে সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যেত।
রাহাত অনুভব করত—ভালোবাসা মানে কেবল মুগ্ধতা নয়, মানে প্রতিদিনের ছোট ছোট ত্যাগও।
এক রাতে ঝগড়ার পর দু’জন নীরবে বসেছিল বারান্দায়।
নদীর হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল।
ঐশী হঠাৎ বলল,
“তুমি জানো, ভালোবাসা মানে প্রাপ্তি নয়, বরং পাশে থাকার সাহস। আমি থাকব তোমার পাশে—যতটুকু পারি।”
রাহাত চোখ তুলে তাকাল—সেই চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল শুধু মমতা।
তার মনে পড়ল, নিশাতের হারানোর ব্যথা, ঐশীর পাওয়ার প্রতিশ্রুতি—সব এক হয়ে গেছে এক স্রোতে।
বছর দু’য়েক পর, রাহাত প্রমোশন পেল, ঐশী বদলি হলো অন্য জেলায়।
চিঠি, ফোন, দেখা—সবই চলল, কিন্তু দূরত্ব বাড়ল।
তবু রাহাত জানত—এবার আর কিছু হারানোর ভয় নেই।
কারণ সে শিখেছে—অপ্রাপ্তিও একধরনের প্রাপ্তি, যদি তুমি নিজেকে হারাও না।
শেষ দৃশ্যে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে সেই নদীর সেতুতে, যেখানে সে একদিন ঐশীকে প্রস্তাব দিয়েছিল।
সূর্য ডুবছে আবার।
সে মনে মনে বলল—
“ভালোবাসা মানে পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে বেঁচে থাকা।
যে জীবন আমাকে ভেঙে দিয়েছে, সেই জীবনই আমাকে গড়েও তুলেছে।”
শেষে নিঃশব্দে মিশে যায় অস্তরাগ
যেখানে রাহাতের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি দুটোই হয়ে যায় তার জীবনের সৌন্দর্য।
লেখক:আবু তালেব সিদ্দিকী, কবি, উপন্যাসিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

