প্রায় ২৯ বছর আগে বাংলাদেশের বুক থেকে এক উজ্জল নক্ষত্র ফাগুনের রঙ্গে বিষাদ ছড়িয়ে উচ্চতর বিচারাঙ্গণ থেকে চিরতরে বিদায় নেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী। ১৯৯৫ সালের ৫ জুলাই, ৬১ বছর বয়সে গুণী এই মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কাঁদিয়েছে সবাইকে। তিঁনি তাঁর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন বিচারকার্য পরিচালনার সময়ে সুপ্রিমকোর্টের এজলাসে বসেই। তাঁর মতো একজন বিজ্ঞ বিচারপতির অসময়ে মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বিচার বিভাগের তথা দেশ ও আপাময় জনসাধারণের।
তিঁনি ছাত্রজীবন থেকেই শুরু করে কর্মজীবন পর্যন্ত জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন যাতে করে সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। তাই ১৯৯৫ সালের ৫ জুলাই আমাদের জন্য গভীর দু:খের ও বেদনার।
মরহুম বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী ছিলেন স্পষ্টবাদী, নির্লোভ, সৎ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিঁনি আইন পেশাকে গ্রহণ করেছিলেন নিছক অর্থ উপার্জনের জন্য নয় বরং দেশে ন্যায় ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। আইন পেশা একটি স্বাধীন পেশা, আজীবন স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়েই তিঁনি কাজ করে গেছেন।
বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী ছিলেন একজন প্রথিতযশা আইনজীবী এবং তাঁর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পরবর্তীতে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি সবার সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করতেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করতেন এবং বিচারপতি হিসেবে তার কোনো অহংকার ছিলো না।
প্রয়াত বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী নওগাঁ জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি রাজশাহী জেলার লোকনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করে ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূব পাকিস্তান হাইকোর্টে এবং ১৯৬৮ সালে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টে আইন পেশায় যোগদান করেন। তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা এবং আন্তরিকতার কারণে অতি অল্প সময়ে আইন পেশায় প্রতিপত্তি ও খ্যাতি লাভ করেন। বলাবাহুল্য, বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী সত্যিকারের একজন আইন বিশারদ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি যখন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস করতেন তখন যে কোনো আইন বিষয়ক সমস্যা অতি সহজেই যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন। অনেক আইনজীবীই তার কাছে বিশেষ করে আইনগত দিক থেকে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে পরামর্শ নিতেন এবং তিনি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তাদের প্রযোজনে।
মরহুম বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় তিনি পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়েন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ২০০১ সালে মাতৃভাষা পদক পান (মরণোত্তর)। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হন পরে আল্লাহ্তায়ালার অশেষ রহমতে মুক্তি পান।
প্রযাত বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে সর্বদাই দেশের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করতেন, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জনসাধারণের উন্নতির জন্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সার্বিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ১৯৬৮ সালে সুপ্রিমকোর্টে আইন পেশার পাশাপাশি রাজশাহী -খুলনা বিভাগ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং নওগাঁ জেলা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ও উত্তরাঞ্চলীয় বৈষ্যম্য দূরীকরণ পরিষদের সভাপতি থাকাকালীন সমগ্র বাংলাদেশ তথা উত্তরবঙ্গের জনসাধারণের কিভাবে উন্নয়ন করা যায় সেদিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখতেন। তার চিন্তা চেতনা ও দাবি দাওয়ার মধ্যে ছিল বড় বড় প্রকল্প যেমন যমুনা সেতু নির্মাণ, রূপপুর আনবিক শক্তি প্রকল্প স্থাপন, চুনা সিমেন্ট প্রকল্প, সার-কারখানা, শিল্প কারখানা ইত্যাদি স্থাপন করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি যে সব প্রকল্পগুলো স্থাপনের জন্য দাবি উপস্থাপন করে গিয়েছিলেন তা আজ প্রায় সবই বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী সুপ্রিমকোর্টে আইন পেশার পাশাপাশি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান লিগ্যাল এইড সোসাইটির সহ সভাপতি হবার পাশাপাশি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ট্রেজারার ছিলেন এবং দুই বার সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের, তদানিন্তন রংপুর হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের দুই দুই বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।
প্রয়াত বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলী আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিচারপতি হিসাবে সর্বদাই নিয়মনীতি এবং শৃংখলা মেনে চলতেন। তিনি আদালত চলাকালীন সময় বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং এক নিরপেক্ষ ও সততার সঙ্গে বিচারকার্য পরিচালনা করে গেছেন। তার সততা ও অসংখ্য উল্লেখযোগ্য রায়ের জন্য তিনি বিচার বিভাগে সবার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার লেখা রায়গুলো মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রয়াত এই বিচারপতির স্ত্রী রওশন আরা বেগম বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজ এবং ঢাকাস্থ সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ছিলেন। তাদের তিন ছেলের মধ্যে সদ্য প্রয়াত চট্টগ্রাম আর্মি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ রফি ছিলেন বড় সন্তান। দ্বিতীয় সন্তান আহমেদ রেজা বেলজিয়ামে পড়ালেখা শেষ করে বেলজিয়ামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত আছেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। জনাব বারিস্টার আহমেদ সোহেল হচ্ছেন তাদের কনিষ্ঠ পুত্র, তিনি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ৪ নভেম্বর ২০২৫ তিনি জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বও ২০২৫ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে তাকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা, ২০০৭-এর বিধি ৩ (২) (খ) এবং বিধি ৩ (৩) এর বিধানমতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি আহমেদ সোহেলকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে ৫ বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করেছেন। বিচারপতি আহমেদ সোহেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশে বি.এসসি(অনার্স), এম.এস.সি, যুক্তরাজ্যের উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (অনার্স), যুক্তরাজ্যের লিংকন’স ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল আইসিএসএল এবং লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে আইনগত দক্ষতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন।
বিচারপতি মোহাম্মদ আনসার আলীর মৃত্যু আইনাঙ্গনে এক বিরাট শুন্যতা সৃষ্টি করেছে। তার সর্বদা হাসি-খুশি মিষ্টি মধুর কথা, সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, অধ্যবসায়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বিচারকার্য পরিচালনায় দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা সর্বজন স্বীকৃত। বিচারাঙ্গণে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

