দূর নক্ষত্র – পর্ব – ০৪

ইসমাইল হোসেন ইসমী

by sondeshbd.com
729 views

চঞ্চলতায় ভরে ওঠে ইয়েলের মন। আবেগের তাড়নায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ওর মাথায় এলোমেলো চিন্তার পোকা ঢুকে গেছে। কিছুতেই বের করতে পারে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চাঁদ উদ্ভাসিত হয়েছে অপরূপ রূপে। কী দারুণজ্যোৎস্নাভরা রাত। এমন রাতে চাঁদের আলোয় গায়ের পশম পর্যন্ত দেখা যায়। জ্যোৎস্না উপভোগ করার জন্য গ্রামের ছোটো ছেলেমেয়েরা বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে সবাই একসাথে গল্পে মেতে ওঠে। কেউ কেউ আবার দল বেঁধে উঠোনে খেলা করে। রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসে জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মাখে। ইয়েলের মনের ভেতরে জ্যোৎস্নার মতোসোনালি আলো জ্বেলে রেখেছে ইলা। সেই ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি। ওর অস্তিত্ব,ওর অনুভব,ওর অনুভূতির ছোঁয়ায় ছলছল করে গড়িয়ে পড়ে মনের অজান্তে। আজ যে-করেই হোক তাকে ইলার সাথে দেখা করতেই হবে।
ভাবতে ভাবতে একসময় পৌঁছে যায়ইলাদের বাসার কাছে। সাহস করে উঠোন দিয়ে চলে যায় জানালার কাছে। ফিসফিস করে জানালার কাছে গিয়ে ‘ইলু’ বলে ডাকে। কিছুক্ষণ থেমে আবার ডাকে,‘ইলু,উঠো।’ ইলা ঘুমের রাজ্যে বিভোর। যতই ডাকে ওর কোনো সাড়াশব্দ নেই। রুপোর কাঠি দিয়ে ডালিমকুমারযেন ঘুমিয়ে দিয়ে গেছে। ইয়েলেররুপোর কাঠি নেই কিন্তু পাটের কাঠি তো আছে। বাড়ির পেছনের দিক থেকে পাটের কাঠি নিয়ে আসে সে। জানালা দিয়ে পাঠের কাঠি দিয়ে ওর শরীরে স্পর্শ করতেই ইলা পাশ ফিরে যায়। এবার একটু জোরে গুতো দেয়। ইলা বিছানা ছেড়ে উঠে এদিন-ওদিক খোঁজে। দেখে জানালার কাছে ইয়েল দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে একটু ভেবে নেয়। বের হয়ে আসবে কি আসবে না বুঝতে পারে না।ইয়েল বারবার হাত দিয়ে ইশারা করে বাইরে ডাকে। ইলা ভেতরে ভেতরে ওর অবস্থা দেখে খুব মজা পাচ্ছে।
বিছানা ছেড়েইলা নেমে আসে দরজার কাছে। অতি যত্ন করে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বের হওয়ার আগে একবার দাদিকে দেখে নেয়। তাড়াহুড়ো করে ওড়না না নিয়েই চলে আসে। দুজনে চলে যায় জামতলায়। দুদিকে দুইটা জামগাছ তার মধ্যখানে একটা বাঁশের বেঞ্চপাতা আছে। দুজনে প্রায় নির্জন রাতে এসে এখানে বসে বসে গল্প করে।
ইয়েল বসতে বসতে ইলাকে বলে,‘মন খারাপ কেন?’
‘বা রে! তুমি চলে যাবে আর আমি উচ্ছ্বাসে মেতে থাকব?’
‘একবারে চলে যাচ্ছি না। যত তাড়াতাড়ি পারি ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে চলে আসব।’
‘একদিন আমি কী করে থাকব?’
‘আমার অনুভবের বিশ্বাস নিয়ে থাকেবে।’
‘আমার বড্ড ভয় করছে ইয়েল।’
‘আমার উপর বিশ্বাস রাখো।’
‘বিশ্বাস আছে কিন্তু তোমাকে না দেখলে আমার ঘুম যে আসে না।’
‘আমাকে কল্পনায় নিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।’
আর কোনো কথা বলতে পারে না দুজনে। চেয়ে থাকে একে অপরের দিকে। ধীরে ধীরে ইয়েল আরও গা ঘেঁষে বসে।ইলাও আস্তে করে ওর দিকে সরে আসে। ইয়েল দুহাত প্রসারিত করে বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। বেঞ্চের দুই প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসে মধ্যখানে এক হয়ে যায় মুহূর্তেই। দুজনে দুজনের মাথাকে একে অপরের বাহুডোরে রাখে। যেন এক জীবন, এক আত্মা, এক মন, এক হৃদয়।কথা নেই কারও মুখে, শুধু চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। আবার দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো। চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে যেতে থাকে বাতাসে। সেই কান্নার আওয়াজে আকাশবাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

রাত পোহালেই ইসলামি মাহফিল। মাহফিলের জন্য ধরমপুর কামিল মাদ্রাসার মাঠে তৈরি করা হয়েছে বিরাট প্যান্ডেল। মহিলাদের জন্য আলাদা বসার জায়গা, সাথে অজুর পানির ব্যবস্থা। গতবারের চেয়ে এবার বেশি লোকসমাগম হবে বলে গ্রামে-মহল্লায় আলোচনা হচ্ছে। মাহফিলের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে আল্লামা সুফি মুফতি ইমাম ইসমে ওমর জাফরি সাহেব। যেমন তার কণ্ঠ তেমন তার উপস্থাপনা। তিন বছর আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয়, না হলে পাওয়া যায় নাতাঁকে। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে এ রাতটির জন্য। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মেহমান আসে।
গ্রামগুলোতে ইদের আমেজের মতোই উৎসব লেগে গেছে। প্রায় সকল বাড়িতে নানারকম রান্নার ধুম পড়েছে। সেই সাথে শেষবারের মতো প্যান্ডেল দেখে নিচ্ছে, কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না। ইমরান ডাক্তার, গিয়াস মুহুরি, আব্দুল হাকিম, সাদেক মাস্টার, মৌলবি মোশাররফ’সহ অনেকেই প্যান্ডেলে বসে আছেন। সর্বশেষ অবস্থা ঝালাইকরে নিচ্ছেন তারা। প্রধান বক্তা এখনও এসে পৌঁছাননি। বদি পাগলা হাঁপাতে হাঁপাতে আসে মাদ্রাসার মাঠে। পাগলা কিছুই বলতে পারে না, শুধু হাঁপায় আর হাঁপায়।
বদি পাগলার অবস্থা দেখে ইমরান ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেন,‘কী রে কী হয়েছে?’
কোনো কিছু বলে না বলে বদি পাগলা। হাঁপাতেই থাকে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘বড়ো হুজুর আসেননি। শুধু ছোটো হুজুর…’ বলেই আবার হাঁপাতে থাকে।
‘বড়ো হুজুর আসেননি!’ বলে ডাক্তার সবার দিকে তাকান।
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সবাই সবার চোখের দিকে তাকান।
বদি পাগলার কথা শুনে ডাক্তারের মুখটা কালো হয়ে যায়।‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল!’ বলে হাঁটা শুরু করেন।
সবাই ইমরান ডাক্তারের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যান। ডাক্তার বাড়ি এসে দেখেন প্রধান বক্তার সহকারী চেয়ারে বসে আছেন। ডাক্তারকে দেখেই সালাম দেন।
ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলেন,‘কেমন আছেন?’
ছোটো হুজুর বলেন,‘ভালো আছি।’
ডাক্তার বলেন,‘বড়ো হুজুরকে দেখছি না। হুজুর কোথায়?’
ছোটো হুজুর কোনো কথা না বলে মাটির দিকে চেয়ে থাকে।
ডাক্তার আবার বলেন,‘হুজুর, কিছু বলছেন না কেন?’
ছোটো হুজুর আমতা আমতা করে বলেন,‘বড়ো হুজুর হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
ছোটো হুজুরের কথা শুনে ইমরান ডাক্তারের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। একটু সময় নিয়ে চেয়ারের সাথে শরীরখানা লাগিয়ে বলেন,‘আগামীকাল অনুষ্ঠানের কী হবে?’
ছোটো হুজুর বলেন,‘দেখুন অসুস্থ হলে তো…’
বড়ো একটা নিশ্বাস ছেড়ে ডাক্তার বলেন,‘সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। সব শেষ হয়ে গেল।’ এ বলে আর্তনাত করে ওঠেন।
ইয়েল বলে,‘ডাক্তার নানা,শান্ত হন। খোদার উপর ভরসা রাখেন।’
‘এত অল্প সময়ে কাউকে পাওয়া যাবে না।’
গিয়াস মুহুরি বললেন,‘ডাক্তার ভাই, আপনি চিন্তা করবেন না। খোদা একটা উপায় বের করবেন।’
ডাক্তার আবার বলে ওঠেন,‘আর কিছুই করা সম্ভব নয়। এত অল্প সময়ে কী করা যাবে?’
ইয়েল বলে,‘একটা কাজ করতে পারি আমরা, আরেকজনকে নিয়ে আসা যায় কিনা…’
‘কাউকে এসময়ে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ইয়েল, কিছু একটা কর, ভাই আমার। উপায় বের কর।’
ইয়েল বলে,‘একটা কাজ করা যেতে পারে ডাক্তার নানা।’
ডাক্তার বিরক্ত হয়ে বলেন,‘ভনিতা না করে কী করা যায় বলে ফেল।’
শাহজাদা ডক্টর সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ আল-হাসানী ওয়াল হোসাইনী হুজুরকে আনতে পারি আমরা।’
সঙ্গে সঙ্গে ছোটো হুজুর বলে উঠলেন,‘তাঁর নাম শুনেছি। শুধু সুফিজমের কথা বলেন।’
ডাক্তার রেগে গিয়ে বলেন,‘আপনারা কি আকাশের কথা বলেন?’
ছোটো হুজুর কোনো উত্তর দেননা।
ইমরান ডাক্তার বলেন,‘আমাদের এছাড়া কোনো পথ নেই রে ইয়েল। তাকে নিয়ে এসে কিছুটা হলেও লোকজনকে বুঝ দেওয়া যাবে।’
‘এখন আমি কী করব ডাক্তার নানা?’
সবাই একসাথে বলেওঠেন,‘তাকে নিয়ে আসা ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নেই। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতে হবে। খারাপের চেয়ে কিছুটা ভালো হবে। সবার মুখটা রক্ষা পাবে।’
ডাক্তার বলেন,‘ইয়েল, তাকে আনার ব্যবস্থা কর। তাড়াতাড়ি কর, আজকের শেষ বাসটাযে-করেই হোক ধরতে হবে তোকে।’
‘ঠিক আছে’, বলে ইয়েল ঢাকার পথে রওনা হয়ে যায়।

রাত থেকেই উত্তুরের বাতাস আর প্রচুর কুয়াশা পড়তে শুরু করে। চারিদিকে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা আর কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে ভ্যানগাড়িতে চড়ে ইয়েল রওনা হয়ে যায়। ওকে যে-করেই হোক শেষ বাসটা ধরতে হবে।কিন্তু রাস্তা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। অনেক কষ্ট করে কাশিয়াডাঙা পর্যন্ত পৌঁছে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা হানিফ বাস দেখতে পেয়ে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে ইয়েল।
খুব সকালে ঢাকায় পৌঁছায় সে। বাস থেকে নেমে পড়ে কল্যাণপুরে। তারপর রিকশা করে যায় হুজুরের বাসায়, মিরপুরে। মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে তাঁর বাসা খুঁজেপায়। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে সরাসরি উঠে যায় চার তলায়।চার তলায় গিয়ে নামঠিকানা লিখে দেয় হুজুরের সহকারীর কাছে। ডাকের অপেক্ষায় থাকে সে। শাহজাদা হোসাইনী একজন নুরানি চেহারার অধিকারী।সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সুফি স্কলার্স বিষয়ে ডক্টরেট করে দেশে ফিরে এসেছেন বিধায় হাজারো লোকের সমাগম ঘটেছে আজ। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে ওর ডাক আসে। ডাক পেয়ে ভেতরে যায় ইয়েল। সালাম বিনিময়ের পর সবকিছু বুঝিয়ে বলে হুজুরকে।
শাহজাদা হোসাইনী জিজ্ঞাসা করেন,‘কেমন লোকজন সমাগম হতে পারে?’
ইয়েল বলে,‘একুশ গ্রামের মাহফিল এটা। এগারো কিলোমিটার সার্কেলের প্রায় সব মানুষ মাহফিলে আসবে। সবার মধ্যে সাজসাজ রব। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন আসে।’
দুইশ সত্তর কিলোমিটার দূরত্ব শুনে হুজুর আমতা আমতা করতে লাগলেন। ইয়েল নাছোড়বান্দা। হুজুরকে রাজি করানোর সবরকম চেষ্টা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হুজুর যেতে রাজি হলেন। ইয়েল বলে ওঠে, হে খোদা, তুমি আমায় রক্ষা করলে। তুমি রহমানুর রাহিম। সবকিছু গুছিয়ে নেন হুজুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।

ফজরের নামাজশেষ করে সবাই জড়ো হয়েছেনইমরান ডাক্তারের উঠোনে।বড়ো হুজুর আসবেন না এটা প্রচার হয়ে গেছে পাড়াময়। লোকজন এসে যে যেমন পারে প্রশ্ন করতে থাকে। সবার কত প্রশ্ন।ইমরান ডাক্তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। এমন কোনো কথা নেই যে মানুষ বলছে না। যেন স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের দায় পালন করছে তারা। কারও মুখে কোনো কিছু বলতে বাধে না। ডাক্তারের মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেছে। শেষ পর্যন্ত চুপচাপ থেকে ডাক্তার মুখ খোলেন।
‘ইয়েল রাতেই ঢাকা গেছে। একটা ব্যবস্থা করে ফিরবে। আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। খোদা যেন আমাদের মানসম্মান রক্ষা করেন।’
সবাই একযোগে বলে ওঠে,‘ওহ! ইয়েল যখন গেছে তখন একটা ব্যবস্থা করবে।’
এভাবে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। কোনো খোঁজ নেই ইয়েলের। সবার মুখ আস্তে আস্তে কালো হয়ে যেতে থাকে। সবাই উৎকণ্ঠায় পড়ে যায়। সবাই সবার মুখের দিকে চেয়ে আছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবাই উঠতে যাবে এমন সময় একটা সাদা মাইক্রোবাস ধুলোবালি নিয়ে হাঁকিয়ে আসে ইমরান ডাক্তারের বাড়ির দিকে। মাইক্রোবাসটা এসে থামে তাঁর উঠোনের কাছে। সবাই উৎসুক হয়ে ছুটে যায় মাইক্রোবাসটার কাছে। মাইক্রোবাস থেকে শাহজাদা হোসাইনী হুজুরকে নেমে আসার অনুরোধ করে ইয়েল। অনেক লোকজড়ো হয়ে গেছে উঠোনের কাছে। মাইক্রোবাস থেকে নেমে ইমরান ডাক্তারের উঠোনের দিকে যেতে থাকেন। উঠোনে গিয়ে সবার সাথে শুভেচ্ছা ও সালাম বিনিময় করেন। ডাক্তারের বৈঠকখানায় বসে সবার সাথে আলোচনায় মশগুল হয়ে যান। বেশ কিছুক্ষণ পরে দস্তরখানা বিছিয়ে ওদেরকে খেতে দেয়।
সবাই বলাবলি শুরু করে দিয়েছে,ইয়েল না থাকলে আমাদের মানসম্মান ধুলায় মিশে যেত। আরও কত কথা। কথা বলতে ট্যাক্স লাগে না। বাঙালিকে কথা বলতে না দিলে যেমন বাঁচে না অন্যদিকে ব্রিটিশদের সম্মান না করলে তারাও বাঁচে না। এসব নিয়ে আলোচনা চলছে পুরোদমে। হঠাৎ করে বাইরে প্রচণ্ড কান্না শুনতে পেয়ে ইমরান ডাক্তার বাইরে এসে দেখে জামিলা কাঁদছে।
‘কী হয়েছে জামিলা?’
‘ডাক্তার ভাই, আমার ছেলে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে। আমার ছেলের হাতটা ঠিক করে দেন।’
ডাক্তার অপ্রস্তুত হয়ে বলেন,‘আরে আরে কী কথা! হাড় জোড় দিতে পারি নাআমি।’
‘আপনি ডাক্তার। আপনি পারবেন।’
‘আমি ডাক্তার হলেও হাড় জোড়া দেওয়ার ডাক্তার নই।’
‘আমার টাকা নাই, তাই করবেন না’, বলেই কান্না জুড়ে দেয়জামিলা। কিছুতেই তাঁর কান্না থামছে না।
‘আরে কী হলো, কাঁদিস কেন?’
‘আমার ছেলে ভাঙা হাত নিয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকবে?’ বলেই আবার কান্না শুরু করে দেয়।
‘কোনো চিন্তা করিস না। ডাবল হাজির কাছে নিয়ে গিয়ে তোর ছেলের হাড় ঠিক করে নিয়ে আসবে ইয়েল।’
‘খোদা আপনার ভালো করবেন।’
‘একটা ভ্যানগাড়ি ঠিক কর। ইয়েলকিছুক্ষণ পরেই ডাবল হাজির কাছে নিয়ে যাবে।’
ইয়েলকে ডেকে বলেন, ‘ইয়েল, জামিলার ছেলেটাকে ডাবল হাজির কাছে নিয়ে যা। ভাঙা হাতটা ঠিক করে দেবে।’
‘ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি।’
খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, গোসল নেই। নেই কোনো ক্লান্তি। আছে শুধু ইয়েল আর ইয়েল। কিছুক্ষণ পরে ইয়েলছেলেটাকে নিয়ে চলল ডাবল হাজির বাড়ির উদ্দেশে।
ইমরান ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলেবলেন,‘আজ ইসলামি মাহফিল। বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে লোক আসতে শুরু করে দিয়েছে। যে যেমন পারে এসে বসে পড়ে। কেউ কেউ নিজের পছন্দমতো জায়গায় চেয়ার, ছাতা, লাঠিদিয়ে নির্দিষ্ট করে রেখেছে যাতে কেউ বসতে না পারে।ইয়েল না থাকলে কী হবে আমাদের? ইয়েল শুধু ইয়েল নয়, সর্বময়।’
আসরের নামাজের শেষে দুপুরের খাওয়া শেষ করেই সবার গন্তব্য মাদ্রাসার মাঠে। অনেকেই দুয়েকবার ঘুরে গেছে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পালপুর-ধরমপুর-মালিগাছাসহ একুশটি গ্রামের বৃহত্তর মাহফিল। বয়ান শুরু হয়ে গেছে। সবার বয়ান শেষে অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হোসাইনী হুজুর বয়ান শুরু করলেন। হুজুর প্রথমে সুরা ফাতিহা দিয়ে শুরু করেন। তারপর তাঁর দর্শন সুফি জ্যোতি ও সুফিজম উপস্থাপনা করেন।
‘প্রকৃতিকে নিয়ে ভেবে দেখুন আর কৃতজ্ঞ হোন। মনে করুন আজই আপনার শেষ দিন। খোদা আপনার জন্য যথেষ্ট, আর করও মুখাপেক্ষী হবেন না। খোদার রহমতের অপেক্ষা করুন। তিনি কাউকে নিরাশ করেন না। যার প্রাপ্তি তিনি তা দিয়ে থাকেন। হিংসা এবং অপরের অমঙ্গল কামনা করবেন না। এটা তিনি অপছন্দ করেন। বিপদে ধৈর্য ধারণ করুন। দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করুন। কুরআনের পথে ব্যয় করুন।
বেশি বেশি করে মাতৃভাষায় কুরআন পড়ুন। যদি নিজের মায়ের ভাষায় খোদার বাণী না পড়েন তবে বুঝবেন কেমন করে আপনার জন্য কী কী বিধান দিয়েছেন। অপরের কথায় বিশ্বাস না করে নিজের চোখে দেখে নিজে বিশ্বাসী হয়ে উঠুন। আমি জানলাম না বুঝলাম না আমার সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য শেষ নবির মাধ্যমে কী বাণী পাঠালেন; শুধু ওই বাঁধানো লাল কাপড়ে চুমু খেয়ে গেলাম কিন্তু ভেতরে কী রয়েছে তা আজও জানলাম নাএমন কি হয়?
আপনি যা পাননি তার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না। দুশ্চিন্তা করলে শরীরে অসুখবিসুখে বাসা বাঁধে। সর্বক্ষণ সৎ চিন্তা করুন। কুরআনের আহকামগুলো আঁকড়ে ধরুন। অল্পে তুষ্ট হোন। আপনার জীবনে যেটা দরকার নেই সেটা খোদা আপনাকে দেবেন না। খোদা সবাইকে সবকিছু দেন না। কিছু দেন আর কিছু পরকালে দেবেন। আপনার অতিরিক্ত জিনিসগুলো নিয়ে ভাবুন। অতিরিক্ত জিনিস হলো বিষ। খোদা আপনাকে অতিরিক্ত দেন না বলে খোদাকে দোষারোপ করবেন না। খোদা ছাড়া কাউকে আঁকড়ে ধরবেন না। তিনি সব জানেন, সব বোঝেন। তিনি যতটুকু জানান ততটুকু আমরা জানতে পারি, তার বাইরে আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। তিনি মহামহিম এবং মহাজ্ঞানী। আমার-আপনার রিজিক নির্ধারিত, তাই সেটার জন্য হতাশ হবেন না। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি সব ব্যবস্থা করবেন। তিনি দৃশ্য, তিনি অদৃশ্য।
বেশি বেশি বই পড়ুন। নিজেকে আলোকিত করুন। তবেই দেশ ও সমাজকে আলোকিত করতে পারবেন। জ্ঞান অর্জন করুন, কারণ তিনি জ্ঞানীকে ভালোবাসেন। কথা কম বলুন, দান করুন বেশি। নারীদের প্রতি কোমল হোন, কেননা নারীদের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। পাপ থেকে দূরে থাকুন।শুধু মিথ্যায় আত্মা কলুষিত হয় না, ভোগেও আত্মা কলুষিত হয়। তাই ভোগ(আহার) কম করুন। অন্তরকে বানাতে হবে মন্দির, মসজিদ, উপাসনালয় আর আত্মাকে বানাতে হবে বেদমূল এবং মনকে বানাতে হবে পুরোহিত; তবেই আপনি পাবেন শান্তি আর শান্তি। ভালো আর মন্দ, সত্য আর অসত্য সর্বদা প্রফুল্লচিত্তে ছুটে চলে অবিরত। যে সত্যকে খুঁজে পায় সে-ই তো হয় অক্ষয়। আসুন আমরা আলোর পথে যাত্রার প্রস্তুতি নিই।’
মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনছে হুজুরের বয়ান। লোকজনের নড়াচড়া নেই, কোনো ফিসফাস নেই। এমনকিএ সময় এক ও দুই নম্বর কাজও স্থগিত রেখেছে অনেকে।
শাহজাদা হোসাইনীহুজুর সবাইকে প্রশ্ন করেন,‘আমাদের কাঁধে দুজন লেখকমুনকার ও নাকির রয়েছেন সেটি আপনারা বিশ্বাস করেন?’
সবাই বলে ওঠে,‘হ্যাঁ আমরা বিশ্বাস করি।’
‘এবার বলুন, তাদেরকে চোখে দেখেছেন?’
সবাই বলে ওঠে, ‘না না।’
‘দুইকাঁধে তাদের ভর বা ওজন অনুভব করেছেন?’
সবাই বলে ওঠে, ‘না না।’
তখন হুজুর বলেন,‘এটা আপনাদের বিশ্বাস। আর আমি এটাকে বলি ব্লুচিপ বা ক্যামেরা, যা খোদাতা’আলা আমাদের সবার মাঝে দিয়ে রেখেছেন। আমরা যা করি তার সবই ওই ব্লুচিফে রের্কড হয়ে যায়, আর মুছে ফেলা যায় না। ওটার উপর নির্ভর করবে আমার-আপনার স্বর্গ-নরক। বেশি বেশি আমলে সালেহ বা সৎকাজ করুন।’
এরকম করে আরও কতকিছু বয়ান করে যেতে লাগলেন। কোথাও কোনো পিনপতনের শব্দ নেই। নেই কোনো নড়াচড়া। এ যেন অমৃত সুধা পান করলেন মুসল্লিরা।
সবশেষে লক্ষ কণ্ঠেধ্বনিত হয়,‘ভালো হতে চাই প্রভু। চালিত করও সরল পথে। সব সংযমী আর ধৈর্যশীলদের সাথে। অবিশ্বাসীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করো না কভু। বিবেকসংবলিত কাজ করে যেতে চাই। মহৎ কাজ করার প্রেরণা দাও। যত বাধা আসুক হে সৃজনকারী, সবকিছুর ঊর্ধ্বে পালনকারী, আদিষ্ট হয়ে চেয়ে থাকি ঊর্ধ্ব গগনে। তোমার উপমা সাত আসমান জমিনে। সবকিছু আছে তোমার প্রেরিত বাণীতে। যেশিক্ষা দিয়েছ কিতাবে, বোঝে না যতসব অভাগার দল, নেমে আসে তখন দারুণ যন্ত্রণার ঢল। সৃষ্টির মহিমা রেখেছ সাজিয়ে। যোগ্যতা আছে যার সে নেবে কুড়িয়ে।’
কীভাবে চোখের পলকে তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হলো কেউ বুঝতে পারল না। সবাই মারহাবা মারহাবা বলতে লাগলেন। মাহফিল শেষে সবাই বাড়ির পথে রওনা দেয়। (চলবে)

আরো পড়ুন