সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ

রবিউল করিম

by sondeshbd.com
213 views

বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে, অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। যার কাছে যত বেশী তথ্য সে তত বুদ্ধিমান, সে তত সমৃদ্ধ। এ তথ্য প্রবাহের সূচনাটা এ বঙ্গদেশে আজ থেকে ২৩৭ বছর আগে ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি এর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাঁর, বেঙ্গল গেজেট” নামক সাপ্তাহিক ইংরেজি সংবাদপত্রের মাধ্যমে।

হিকিকে অনুসরণ করে সংবাদপত্রের জগতে এদেশীয় প্রথম অবদান রাখেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও হরচন্দ্র রায়।
“বাঙ্গাল গেজেট” নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন তারা ১৮১৬ সালে। তারপর ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশন থেকে “দিকদর্শন” ও “সমাচার দর্পন” নামে দুইটি সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সংবাদপত্রের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হলো।
সংবাদপত্র সেই থেকেই সামাজিক দর্পনের কাজটি করে চলেছে। দেশ, জাতি, সমাজ এমন কী সমকালীন বিশ্বের চলমান ঘটনা, জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনা, জাতীয় স্বার্থে দিকনির্দেশনা, সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সত্য-সুন্দর এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় পালন করছে তার মুখ্য ভূমিকা।

জনগণ সংবাদপত্রকেই একমকত্র গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার বিকল্পহীন প্রতীক হিসেবে গণ্য করে এসেছিল। কিন্তু ১৯২০ সালে রেডিও ব্রডকাস্টিং হইচই ফেলে দেয় সংবাদপত্র জগতে। সমাজে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করতে থাকে সংবাদপত্রগুলো। সবার মধ্যে এ শঙ্কা জেগে ওঠে যে, সংবাদপত্র ইন্ডাস্ট্রিকে ভূ-লন্ঠিত করে দেবে রিডিও। কিন্তু সে প্রতিযোগিতার জবাবে, সংবাদপত্রগুলো আরও প্রশস্ত ও অপেক্ষাকৃত বিস্তারিতভাবে পরিবেশনের জন্য আর্টিকেল বৃদ্ধি করে, পত্রিকার ফরম্যাট ও বিষয়বস্তু আরও বৈচিত্র‍্যময় করে বা বলা যায় পুরো খোলনলচে পাল্টে ফেলে যতটা ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল ঠিক ততটা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

রেডিওর সাথে মানিয়ে নিতে না নিতেই সংবাদপত্রের সামনে আরেকটি নতুন ও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মাধ্যম এসে হাজির হলো, তা হচ্ছে টেলিভিশন। ১৯৩৭ সালে বিবিসি রাজাকে সমাহিত করার দৃশ্য টেলিভিশনের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে প্রচারের ফলে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয় তা দিনে দিনে আরও বেগবান হচ্ছে। সাদাকালোর যুগ থেকে আমরা রঙ্গিন টেলিভিশনের যুগে প্রবেশ করেছি। এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়তার বিচারে টেলিভিশন প্রথম মাধ্যম হিসেবে আমাদের কাছে প্রতিভাত। টেলিভিশন প্রতিনিয়ত যেভাবে ব্রেকিং নিউজ বা খবরের পর খবর এবং খবর নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছে তাতে করে সংবাদপত্র অনেকখানি তাজা খবর থেকে দুরে অবস্থান করছে।

তবে ১৯৭৪ সালে ব্রুস পারেল ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় “প্লাটো” প্রক্রিয়ায় একটি অনলাইন সংবাদপত্র চালু করেন “অনলাইন অনলি” ধারায়। তার “নিউজ রিপোর্ট” -ই প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র বা সাময়িকীর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও সেসময় এ অনলাইন সংবাদ পরিবেশন মাধ্যমটি তত বেশী কার্যকর হয়ে ওঠতে পারেনি, কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল এ যুগে যার মাধ্যমে সব খবর আমরা মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে থাকি তা হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র।

যার পরিধি পুরো বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে বসে যে কোন সময় পুরো বিশ্বে ঘটে যাওয়া সব খবর আমরা জানতে পারছি, ঘটে যাওয়া যে খবর পত্রিকার পাতায় আসছে কাল সকালে কিংবা আরো পরে ওই খবর মুহূর্তেই চলে আসছে অনলাইন পত্রিকায়। এমনকি তা টেলিভিশনে পরিবেশনের আগেই আমাদের জানিয়ে দিতে পারছে। খবর জানার সময় এখন পরে নয় এ দাবিটি পুরোটাই পূরণ করছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। বর্তমানে দেশে ও বিদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রচুর। এ ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষ অনলাইন সংবাদপত্রের পাঠক। এখন তাই সংবাদপত্রগুলোও এই চাহিদাকে মাথায় রেখে অনলাইন ভার্সন চালু করছে।

এখন ভবিষ্যতের সংবাদপত্র কেমন হবে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হলে, এ কথা সহজেই বলা যায যে তা হবে অনলাইনভিত্তিক। আর এ বিপ্লবকে তরান্বিত করছে মোবাইল ফোন। এখন মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারছি দেশে ও বিদেষের যে কোন সংবাদমাধ্যমের সাথে। যদিও ইন্টারনেট এখনও সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি শুধু আমাদের দেশ কেন পৃথিবীর অনেক দেশেই।

কিন্তু সার্চ ইন্জিনের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান গুগল পরিকল্পনা করছে যে, পৃথিবীতে তারা ১০০০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে যা পৃথিবীর ৭৫% অঞ্চলকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসবে। যদি এটি সত্যিই তারা কার্যকর করতে পারে তবে সেটি হবে পৃথিবীর মানুষের জন্য অভাবনীয় বিষয়।

সেদিন বোধকরি বেশী দুরে নয় যখন সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল সব একটা প্লাটফর্মে একটা ডিভাইসের মাধ্যমে আমাদের কাছে সংবাদ পরিবেশন করবে। আলাদাভাবে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল এর অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয় না। যে সংবাদ পাঠ করতে চাইবে সে পড়বে, যে সংবাদ শুনতে চাইবে সে শুনবে, যে দেখতে চাইবে সে দেখবে। যার নমূনা বর্তমানে অনেকটায অনুধাবনযোগ্য। একটা মুক্ত সংবাদ প্রবাহের যুগে আমরা বাস করবো এবং সেই যুগে আমরা ধাবিত হয়েছি মাত্র, সেটিই হবে সবচেয়ে আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত যাত্রা সংবাদপত্রের। সেই ভবিষ্যত “সংবাদপত্র” হয়তো নাম পরিবর্তন করে “সংবাদকণিক” হয়ে যাবে। আমরা সেই প্রতীক্ষায়।
লেখক: সাবেক অনুষ্ঠান প্রধান, দেশ টেলিভিশন ও সভাপতি, নওগাঁ জেলা মিডিয়া ফোরাম, ঢাকা। (লেখাটি রাজশাহী বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত “বরেন্দ্র কথা”স্বরণীকা থেকে সংগৃহীত।)

আরো পড়ুন