বিকেলটা ছিল শান্ত, নিঃস্তব্ধ। পুকুরপাড়ের নারকেল গাছের ছায়া নরম করে পড়েছিল জলের গায়ে। বাতাসে বরই ফুলের হালকা গন্ধ। গীতালি দাঁড়িয়ে ছিল সেই বরই গাছটার তলে—যেখানে ছোটবেলায় দূরন্ত সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতো, বরই কুড়াতো, জলে পা ডুবিয়ে হাসত। আজও জলে সেই একই প্রতিচ্ছবি, শুধু মানুষগুলো বদলে গেছে।
তখন সে জানত না, পাড়ার সেই ছেলেটা, অমিত, ওকে এতদিন মনে ধরে রেখেছে।
অমিত ছিল চুপচাপ, কণ্ঠে ভদ্রতা, চোখে অগাধ মায়া। একসাথে টিচারের বাড়িতে পড়তে যাওয়া, আঁকাআঁকির সময় ওর চোখে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠত—কিন্তু গীতালি কখনও তা বুঝতে পারেনি। সে ভাবত, ওর মন বুঝা কঠিন।
বছরের পর বছর কেটে গেল। সবাই নিজের নিজের পথে ছুটল।
একদিন, হঠাৎ, এক সন্ধ্যায়—গীতালি বেড়াতে গেল অমিতদের বাড়ি।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন দেখল, অমিত বসে আছে চৌকিতে, পাশে তার বউদি সবজি কাটছে—তার বুকের ভেতরটা কেমন একটা চাপা ধ্বনিতে কেঁপে উঠল। সময় যেন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল।
“কেমন আছো, অমিত?” — সে হাসল, একটু অনিশ্চিতভাবে।
অমিত তাকাল, এক মুহূর্তের জন্য চোখে সেই পুরনো আলোর ছায়া ফিরে এল। তারপর বলল এমন এক কথা—যা গীতালিকে শিউরে দিল।
“ভালো আছি। তবে কেউ কেউ যদি একটু আগে বুঝত…”
বাকিটা থেমে গেল, কিন্তু কণ্ঠে এমন এক ব্যঙ্গ, এমন এক ব্যথা—যা পাশের মুরুব্বিও বুঝে ফেললেন।
গীতালির মুখ শুকিয়ে গেল।
সে বুঝল, অমিত ইচ্ছে করেই কথাটা বলল—যেন চারপাশ জানে, কোনো এক সময় তাদের মধ্যে কিছু ছিল, আর সে গীতালি—অমিতকে অবজ্ঞা করেছে।
সেদিন ফেরার পথে গীতালির চোখে হঠাৎ জল এসে গিয়েছিল।
বুকের ভেতরে গরম-ঠান্ডা এক ঝড়। এতদিনে বুঝল, অমিত আসলে তাকে ভালোবাসত—কিন্তু তা জানাতে না পেরে আজও হয়তো নিজের ভেতরে নাম না জানা এক অভিমান বয়ে বেড়ায়।
তবু সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
ঘাটের সেই শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি আজও আছে, বরই গাছের নিচে ঝরে পড়া ফলের মতো পড়ে আছে তাদের সেই অঘোষিত ভালোবাসা—যার কোনো নাম নেই, কোনো সমাপ্তি নেই।
লেখক: আবু তালেব সিদ্দিকী, কবি, উপন্যাসিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

