বিজয়ের মাস এলেই আমরা নতুন করে ফিরে তাকাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে, যে ইতিহাস আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়, আমাদের স্বাধীনতার মূলভিত্তি। ১৯৭১ সালের সেই মহাকাব্যিক যুদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দলের, কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের নয়; এটি ছিল সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের মহাগাঁথা। বাঙালি জাতির সবচেয়ে কঠিন সময়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, পেশাজীবী সকলেই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল আপন ঠিকানাকে মুক্ত করার জন্য।
এই যুদ্ধ আমাদের দিয়েছে মানচিত্র, দিয়েছে একটি পতাকা, দিয়েছে জাতীয় সঙ্গীত, আর সবচেয়ে বড়ো অর্জন, কথা বলার স্বাধীনতা। আমরা কে, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়েই: আমরা বাংলাদেশি।
এই ইতিহাস আমাদের একদিনে আসেনি। এসেছে রক্তে, অশ্রুতে, ত্যাগে। এসেছে সেই মানুষদের আত্মাহুতির মাধ্যমে, যাদের স্মৃতি আমরা যতবার স্মরণ করি ততবার নত হয়ে যাই শ্রদ্ধায়।
তারুণ্য ও ইতিহাস: ভুল বোঝাবুঝির পথে বিপজ্জনক যাত্রা-
অথচ আজকের কিছু তরুণ সমাজ একটি অদ্ভুত তুলনা টেনে মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ গণঅভ্যুত্থানকে একই কাতারে দাঁড় করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এটি নিছক ভুল নয়, বরং বালখিল্যতা।
কারণ ১৯৭১ আমাদের অস্তিত্বের জন্মক্ষণ; ২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কিন্তু কখনোই স্বাধীনতার সমান নয়, হতে পারে না।
২৪ গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে ছিল বাংলাদেশে নাগরিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এক ফ্যাসিস্ট দমন-পীড়নের যুগের অবসান ঘটিয়ে গণমানুষের শক্তি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের প্রতিরোধে এক শাসক অবশেষে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, এটিও ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো একটি ঘটনা।
কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের সমান্তরালে একে দাঁড় করানো, এটি ইতিহাসের প্রতি অবিচার, জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতি আঘাত।
পরিকল্পিত বিভ্রান্তি ও তরুণদের ব্যবহার-
অনেকে মনে করেন, এই তুলনা তৈরির পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। তাদের ১৯৭১-এর কলঙ্কজনক ভূমিকা আড়াল করতে এবং নিজেদের নতুন বয়ান দাঁড় করাতে তারা আজ ইতিহাসের সিঁড়ি বদলাতে চাইছে।
আর এই কাজে সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য তরুণ সমাজ, যাদের নিষ্পাপ কৌতূহল, তাজা আবেগ এবং অজানা ইতিহাসের ফাঁকফোকরকে ব্যবহার করা যায় খুব সহজেই।
তরুণ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট আজ বিজয়ের মাসে যে ঔদ্ধত্য নিয়ে কথা বলে, আবার সোস্যাল মিডিয়ার রাজনীতিবিদ এর কন্ঠে হুংকার আসে “আমি ১৬ই ডিসেম্বর কে বিজয় দিবস মানি না” বলে বিজয়কে তুচ্ছ করার চেষ্টা করছে, তা শুধু অজ্ঞতার পরিচয় নয়, দেশের ইতিহাস ও আত্মত্যাগের প্রতি সবচেয়ে বড়ো অবমাননা। এই দেশে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে এভাবে অবজ্ঞা করার মতো নিছক মুর্খতা আর কিছু হতে পারে না। ভাবতে অবাক লাগে, যে বিজয় তাদের এই কথাগুলো প্রকাশ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, যে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রঞ্জিত মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করছে, সেই বিজয়কেই তারা উপহাস করছে! এটা কি শুধুই অজ্ঞতা, নাকি পরিকল্পিত উদ্দেশ্য!
আবার দেখা যাচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে তরুণদের বিভ্রান্ত করার জন্যই একটি মহল বারবার মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নোংরা চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এই সংখ্যা বহু আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত, গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত এবং ইতিহাসে চূড়ান্তভাবে নিষ্পন্ন সত্য। তবুও কেন তারা আবার এই বিতর্ক তোলে? উদ্দেশ্য একটাই—ইতিহাসের ভিত নড়বড়ে করা, তরুণদের মনে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ১৯৭১-এর মহত্ত্বকে সন্দেহের ঘেরাটোপে নিয়ে আসা। কারণ তারা জানে, ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেই সত্যকে আড়াল করে নিজেদের অপকীর্তির খতিয়ান ধুয়ে ফেলা সহজ হবে।
ভাববার বিষয় ইতিহাসকে বিকৃত করার যে অপচেষ্টা কিছু মহল বহুদিন ধরে চালিয়ে আসছে, তাদেরই ভাষা আজ তরুণদের মুখে—এ কি কাকতালীয়!
স্বাধীনতার প্রতি আজকের কিছু তরুণের এমন অশ্রদ্ধা দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের বুক যেন আবারও রণাঙ্গনের মতো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। তাদের চোখে ভাসে সেদিনের যুদ্ধক্ষেত্র, সহযোদ্ধার নিথর দেহ, নিজের বুকের রক্ত, আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্রাম, আর শেষ মুহূর্তে বলা সেই নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা: “বাংলাদেশ বাঁচবেই।” অথচ আজ তাদের সেই আত্মদানের ফসলকে যখন উপহাস করা হয়, তখন মনে হয় যেন কেউ তাদের রক্তে ভেজা স্বাধীনতার ওপর পা দিয়েছে। তারা ভাবতে পারেন না, যে তরুণ প্রজন্মকে তারা নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেই তরুণই আজ সেই বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে! এ যেন রক্তের দাম ভুলে যাওয়া এক নির্মম ব্যথা, যা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, গোটা জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করে।
এর চেয়েও বেদনাদায়ক হলো, দেশের কিছু অন্ধ দলীয় সমর্থক এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যে তালি দিয়ে উৎসাহ জোগাচ্ছে। সামান্য রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসকে গালমন্দ করা, শহীদদের প্রতি অবমাননা করা, এটাই কি আমাদের রাজনীতির নতুন সংস্কৃতি? তারা বুঝতে চায় না যে ইতিহাস থাকা মানে আত্মপরিচয় থাকা; ইতিহাস হারানো মানে জাতি হিসেবে পথ হারানো। বিজয়কে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।
এমন অপরিণত, দায়িত্বহীন বক্তব্য কেবল লজ্জার নয়, এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব, পরিচয় ও স্বাধীনতার প্রতি যারা কটাক্ষ করে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। কারণ, ইতিহাসকে অপমান করা যতটা সহজ, তার দায় ততটাই ভয়াবহ।
কিন্তু ইতিহাস বলে, তারুণ্য যত দ্রুত বিভ্রান্ত হতে পারে, তত দ্রুতই সত্যের কাছে ফিরে আসতে পারে। মিথ্যার উপর ভিত্তি করে কোনো প্রজন্মকে স্থায়ীভাবে আটকে রাখা যায় না। ইতিহাসের আলোই শেষ কথা বলে, আর সেই আলো একসময় তরুণদের চোখে ধরা পড়ে নির্মোহভাবে।
বাংলাদেশের তরুণেরা বরাবরই পরিবর্তনের বাহক। তারা একবার পথ হারালেও পথ খুঁজে নিতে জানে। কারণ সত্য ও ন্যায়বোধ, এটাই তারুণ্যের প্রকৃত পরিচয়।
সেই কারণেই কখনোই পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
বিজয়ের মাসে পুনরায় আবিষ্কার হোক প্রকৃত বিজয়ের মূল্য-
বিজয়ের মাস আমাদের শুধু উৎসব নয়; মনে করিয়ে দেয় দায়িত্বও।
মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কোনো একদিনের ঘটনাই নয়; এটি একটি ধারাবাহিক চর্চা।
তারুণ্যকে আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্ম, আর ২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, দুটি ঘটনা একই সরলরেখায় সাজানোর কোনো সুযোগ নেই।
এ মাসে আমরা চাই ঐতিহ্যের আলো তরুণদের মনে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোক উদারতা, মানবিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সঠিক ইতিহাস জানার দৃঢ় সংকল্প।
পরিশেষে-
বিজয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণ আনন্দ, ভালোবাসা আর গভীর গর্বের।
২৪ গণঅভ্যুত্থানের জয়গান অবশ্যই থাকবে ইতিহাসের পাতায়, কিন্তু তার ওপরে ছায়া ফেলতে পারবে না ১৯৭১।
তারুণ্যকে সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে, সত্য থেকে বিচ্যুত না হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।
কারণ এই তরুণরাই একদিন নেতৃত্ব দেবে নতুন বাংলাদেশকে, যেখানে ইতিহাস বিকৃত নয়, বরং ইতিহাস আলোকবর্তিকার মতো সামনের পথ দেখাবে।
তারুণ্য আজ মিশে যাক বিজয়ের মাসে আনন্দে, গৌরবে, এবং সত্যেও অবিচল আলোয়।
আলভি হায়াত রাজ, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব।

