মানুষের জীবনচক্রের যে দীর্ঘ পথ—জন্ম থেকে কৈশোর, যৌবন, পরিণত বয়স, কর্মজীবন, অবসর—তার ভিত্তি তৈরি হয় একেবারে শুরুতে, সেই প্রথম পনের বছরে।
একটি শিশু পৃথিবীতে আগমনের মুহূর্ত থেকেই নিজের ভাষা-বহির্ভূতভাবে যেন জানিয়ে দেয় তার প্রয়োজন, তার অস্তিত্বের দাবি। জন্মের সাথে সাথেই তার কান্না কেবল বেদনার প্রকাশ নয়; এটি নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রথম সাড়া। মাতৃদুগ্ধের প্রথম স্বাদ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে নিজের হাত-পা নাড়ানো, উল্টে যাওয়া, হামাগুড়ি, দাঁড়ানোর চেষ্টা—এ যেন জীবনের প্রথম পাঠশালা। বারবার পড়ে গিয়ে আবার উঠতে শেখার মধ্যেই সে অর্জন করে স্থিতিশীলতা আর সাহসের বীজ।
এরপর ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনের পরিধি বড় হতে থাকে। পরিবার তার প্রথম বিদ্যালয়—মা-বাবার স্নেহ, ভাই-বোনের প্রতিযোগিতা ও বন্ধুত্ব, আত্মীয়-স্বজনের বিভিন্ন আচরণ—এসব মিলেই তার মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি করে। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ—এই পার্থক্য সে শেখে প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনায়।
স্কুলে গিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত হয়। সেখানে শিক্ষা শুধু বইয়ের অক্ষরে সীমাবদ্ধ থাকে না; থাকে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, ভাগাভাগি শেখা, সহমর্মিতায় বড় হওয়া, নিজের পরিচয় তৈরি করা। শিক্ষকেরা তার ভাবনার পথ খুলে দেন, কল্পনার দরজা বিস্তৃত করেন।
কৈশোরে পদার্পণের সময় সে বুঝতে শুরু করে নিজের স্বপ্ন, নিজের আকাঙ্ক্ষা। বাইরের জগতের সঙ্গে প্রতিদিনের মেলামেশা, নানারকম মানুষের সঙ্গে অভিজ্ঞতা, ছোট-বড় সাফল্য-ব্যর্থতা—সব মিলেই গড়ে ওঠে তার চরিত্র, আত্মবিশ্বাস ও জীবনের লক্ষ্য।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে সে নতুন মানুষ চেনে, নতুন দক্ষতা অর্জন করে, সংগ্রাম করে, শেখে, গড়ে ওঠে। কিন্তু যত দূরেই যাক, যতই পরিণত হোক—অবশেষে যখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সে নিজেকে ফিরে দেখে, তখন উপলব্ধি করে জীবনের সেই প্রথম পনের বছরই ছিল সবচেয়ে স্থায়ী, সবচেয়ে প্রভাবশালী।
কারণ, সেই বছরগুলোতেই হৃদয়ে বোনা হয়েছিল জীবনবোধের বীজ, স্থির হয়েছিল চেতনার দিকনির্দেশ, তৈরি হয়েছিল তার ব্যক্তিত্বের মজবুত ভিত। জীবনের প্রথম পনের বছরই আসল; একই সঙ্গে সবচেয়ে কোমল, সবচেয়ে শক্তিশালী, আর সবচেয়ে স্থায়ী।
লেখক:আবু তালেব সিদ্দিকী, কবি, উপন্যাসিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

