দূর নক্ষত্র পর্ব – ০৫

ইসমাইল হোসেন ইসমী

by sondeshbd.com
6 views

বসন্তের প্রহর শুরু হয়েছে সবেমাত্র। গাছেগাছে কোকিলের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। সব গাছে নতুন পাতার বাহার। অনেক ফুলও ফোটেছে। ইলা আজ ‘সুইট সিক্সটিন’-এ পা রাখল।ইলার আজ জন্মদিন। ওর সারা অঙ্গে সোনালি যৌবন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। ইয়েল কয়েকদিনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে। সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা। দুজনেই উৎকণ্ঠায় সময় অতিবাহিত করছে। ইলা আজ সারাদিন ঘর থেকেই বের হয়নি।শুয়ে শুয়ে শুধু চিন্তা করে,আগামী দিনগুলো কাটবে কী করে? যতসব আজেবাজে চিন্তা ভিড় করেছে তার মাথায়। সময় অসময়ে দুই নয়নে ঝরে শ্রাবণের ধারা। ইলার দাদি অনেকবার ডেকেছেন খাওয়ার জন্য। তবুও ওঠেনি। শুয়ে আছে তো আছেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ঝিঁঝিপোকারা ডাকা শুরু করেছে। শুধু ইয়েলের কোনো খবর নেই। ইয়েল আসলেইউঠবে এরকম পণ করে শুয়ে আছে সে।
সব গোছগাছ করে নিচ্ছে ইয়েল। বইখাতা, জামাকাপড় আর কিছু খাবার ব্যাগে ভরে। তবুও মন ভালো হয় না। বিষণ্নতা ওকে ঘিরে ধরেছে।ইলাদের বাড়ি যাবে-যাবে করে সময় হয়নি। গ্রামের সবাই ওর জন্য দোয়া করে। অনেকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যার পরে বন্ধুদের সাথে পালপুর স্কুলের মাঠে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরে আসে। কিছুই ভালো লাগে না তার। বই খুলে বসে। তবুও ভালো লাগে না। গান শুনতেও ভালো লাগে না। সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। তারপরও ওর ভালো লাগে না। কী করবে বুঝতে পারে না সে।
হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে হনহন করেইলাদের বাসার দিকে হাঁটা শুরু করে। অনেকরাতহয়ে গেছে। তবুও তাকে যেতে হবে গন্তব্যে। হাত-পা অবশ হয়ে আসে।তবুও এগিয়ে যাচ্ছে। বাসার কাছে গিয়ে ভাবে কোনদিক দিয়ে যাবে। সরাসরি না গিয়ে পেছনের দিক দিয়ে ঘুরে জানালার কাছে যায়। গিয়ে দেখে ইলা শুয়ে আছে। ইলু বলে ডাকে। ওঠে না ইলা। আবার ডাকে। কিছুতেইউঠে আসে না ইলা। তৃতীয় বারের ডাকে সব মান-অভিমান ভুলে ওঠে। হাতের ইশারা করে বাইরে আসতে বলে ইয়েল। ইলা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঘর থেকে বের হয়ে এসে চলে যায় সেই জামতলার বেঞ্চের কাছে।
বেঞ্চের উপর দুই প্রান্তে দুজনে বসে।বসতে বসতে ইয়েল বলে,‘আগামীকাল ঢাকা চলে যাচ্ছি ইলু।’
‘হুম, তা জানি।’
‘তোমার বলার কিছু নেই?’
‘বলার কী আছে, সেই ছোটোবেলা থেকেই শুনেএসেছি, দেখেএসেছি। জীবনে কম তো দেখলাম না। ট্যালেন্টরা এমনই হয়।’
‘বুঝেছি, অনেক রাগ করেছ।’
ইলার কাছে এসে হাতে হাত রাখে ইয়েল।হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,‘ভদ্রতা বজায় রাখো।’
‘তোমার কাছে এলে কি আমি ভদ্র থাকতে পারি?আমি ভদ্র ছিলাম কবে তোমার কাছে? আমার অভদ্রতা আরও বেড়ে যায় তোমার কাছে আসলে।’
‘নিজেকে এখন থেকে সংবরণ করতে শেখো। অনেক খেলা হয়েছে, এসব ভাল্লাগে না আমার। তুমি বিহনে এ জ্বালা কেমনে সইব? এ জ্বালা মেয়েরা শুধু বোঝে।’
‘ছেলেরা যে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে সেটা দেখো না তোমরা?’
‘ছেলেরা যখন আরেকজন পেয়ে যায় তখন সে আগুন ধপ করে নিভে যায়।’
‘গ্যাসের ট্যাবলেটের মতো কিছুক্ষণের জন্য উপশম মাত্র।’
‘এক ট্যাবলেটে কাজ না হলে আবার নতুন ট্যাবলেট খুঁজে বেড়ানো।’
‘আমি সে ধরনের না ইলু। তুমি শুধুই আমার, অন্য কারও নও।’
‘কী করে বুঝব তুমি আজীবন আমার হয়ে থাকবে?’
‘এতদিন এত কাছে থেকেও বোঝোনি?’
‘তবে আজ কেন চাইছ অন্যকিছু? ওহ্, ভালোবাসাবাসি করলেই বুঝি ওসব করতে হয়?ওসবের বিশ্বাসের বিশ্বাসী নইআমি। আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা পবিত্র।’
বলতে বলতে ইলার স্বর চড়ে যায়। দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ইয়েল বলে,‘ছিছি! মানুষ শুনবে।’
‘শুনুক, জানুক সব জনতা। জেনে যাক বিশ্ববাসী। তোমাকে আমি ভালোবাসি। সেটা সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই।’
‘বড্ড বেশি সাহস হয়েছে দেখছি।’
‘এটা ভালোবাসাবাসির সাহস।’
‘অনেক সাহস দেখলাম। দয়া করে এবার একটু শান্ত হও।’
‘হলাম শান্ত। বলো কী বলবে?’
‘তোমাকে অনেক কিছু আমার বলার আছে।’
‘আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে।’
‘বলো। কোনো কিছু গোপন রেখো না।’
‘আমার সবই প্রকাশিত। তুমি সব জানো।’
‘আরও কিছু জানতে চাই।’
তারপরে ওরা আর কিছু বলতে পারে না। মায়াভরে একে অপরের চোখের দিকে চেয়ে থাকে।
‘যদি কখনও তোমায় দেখতে ইচ্ছে হয়?’
‘জানালার পাশে এসে চাঁদকে দেখে নিয়ো।’
‘আর তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে তখন।’
‘জানালার ধারে দাঁড়ালে বাতাস এসে তোমায় স্নিন্ধ করে দেবে।’
‘আর কবে দেখা হবে আমাদের?’
‘তোমার হৃয়দ জানে।’
তাপরই ইয়েলের হাতটা নিয়ে ইলা তার মাথায় উপর রেখে বলে,‘কোনোদিন আমাকে কষ্ট দেবে না। দুঃখ দেবে না। অবহেলা করবে না আমায়।’ কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার বলে,‘আমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েমানুষকে ভালোবাসবে না। বিয়ে করবে না আমাকে ছাড়া। ঢাকায় গিয়ে প্রতি সপ্তাহে চিঠি দেবে আমায়।কথা দাও।’
‘ভালোবাসা তো দূরের কথা, স্পর্শ করেই দেখব না। এই যে ছুঁয়ে তোমাকে কথা দিলাম।’
ইয়েল গাছের দুটো পাতা ছিঁড়ে নিয়ে বলে,‘হে গাছের পাতারা, তোমরা জেনে রেখো আমি শুধুই ইলুর। সে আমার জীবনেরশিরা-উপশিরায় মিশে গেছে।’
ইলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে ইয়েলকে। ওর বুকের কাছে মাথা রেখে জড়োসড়ো হয়ে রইল। সময় অতিবাহিত হতে থাকে। ওরা বুঝতে পারেনি রাতের শেষ প্রান্তে এসে গেছে।
সকালের আলো ফুটে উঠে ধীরেধীরে অন্ধকার সরে যাচ্ছে। ইলাকে ডেকে তুলে ইয়েল, ‘ইলা, আর থাকা যাবে না।অনেক থাকলাম আজ। চলো এখন। বাড়ি ফিরে যেতে হবে।’
ইলা বলে,‘আরেকটু থেকে যাও।’
‘অনেক হয়েছে।এবার যেতে হবে আমাদের।’
ইলা বলে,‘সত্যিই যেতে হবে? আরেকটু থাকলে হয় না?’
‘লোকজন দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। এখন চলো। চিঠি লিখে তোমাকে সব জানাব, কেমন?’
‘গিয়ে চিঠি দেবে তো? সত্যি করে বলো।’
‘দেবো। এখন চলো।’
‘ঠিক আছে।’
দুজন দুজনার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে যায় যার যার বাসায়।
ইলার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরেরদিন ইয়েল ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। ঢাকায় এসে ওঠে কল্পনার মিরপুরের বাসায়। তিনদিন পরে ফার্মগেইটের তেজতুরি পাড়ায় প্রফেসর শহিদ মনজু স্যারের বাসায় পড়তে আসে। মিরপুর থেকে বাসে আসা যাওয়া করে। খরচ হয় দিনে মাত্র পাঁচ টাকা। সে পানসিগারেট কিছুই খায় না। এখনও তেমন কোনোবন্ধুবান্ধব হয়নি। যাওয়া দুই টাকা, আসা দুই টাকা। যেতে সময় বেশি লাগে না।
কয়েকদিন থাকার পরে ইয়েল হাঁপিয়ে ওঠে। সহ্য করতে না পেরে ফার্মগেইটের আাশেপাশে মেসের অনুসন্ধানে নামে। কয়েকদিন খোঁজ করার পরে পেয়েও যায়। সেটা ফার্মগেইটে নয়, পিজি হাসপাতালের পাশে বাংলার হাটবাজারের একটা নিরিবিলি ছিমছাম পরিবেশের মেস। ২/১৩-ক,নবাব হাবিবউল্লাহ রোড়, শাহবাগ,ঢাকা। প্রতি সিট দেড়শ টাকা। একটু দূরে হলেও পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করা যায় সহজে। এবার চোখমুখ বন্ধ করে স্যারের কাছে পড়তে শুরু করে। কয়েক মাস পরেই শুরু হবে ভর্তিপরীক্ষার যুদ্ধ।

পালপুর হাই স্কুলে ম্যাথের টিচার হিসেবে আসেন বিনয় নামে একজন তরুণ শিক্ষক। জায়গির হিসেবে ইলাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয় তার।ইলার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। স্কুল ছুটির পরে সন্ধ্যাবেলায় তাকে পড়ানোর দায়িত্ব পায় বিনয়বাবু। প্রতিদিননিয়ম করে তাকে ম্যাথ, ইংলিশ পড়াতে লাগলেন। যদিও তাকে পড়ানোর চেয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন বেশি। সে যদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, তিনি উঠোনে পায়চারি করতে থাকেন। দল বেঁধে খেলার সময়ে তিনি এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করেন। গোসল করে ফিরে আসার সময় সামনে দিয়ে পুকুরঘাটে চলে যান। জানালা খুলে পড়ার অভ্যেস ইলার। তিনি কিছুক্ষণ পরপর জানালার পাশ দিয়ে শব্দ করেআসা যাওয়া করেন। কখনও-সখনও জানালার কাছে এসে বলেন, ‘ম্যাথ বুঝতে না পারলে আমার কাছে বলতে লজ্জা করো না।’ সে কোনো কিছু না বলে মাথা নিচু করে রাখে। বিনয়বাবুর ঘরে খাবার দিতে গেলে বলেন, ‘বসো, চলে যাচ্ছ কেন?’সে কিছু না বলে খাবার রেখে নিঃশব্দে চলে আসে।
কিছুদিন পরে হেডমাস্টারকে ধরে ইলার ক্লাসের ক্লাস নিতে শুরু করেন বিনয়বাবু। প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে গিয়েইতাকে পেছনের বেঞ্চে দেখে বলেন, ‘তুমি কেন পেছনের বেঞ্চে? আগামীকাল থেকে প্রথম বেঞ্চে বসবে।’
বিনয়বাবুর কথা শুনে সে দুদিকে মাথা দোলায়।
বোর্ডে ম্যাথ করার সময় বলেন, ‘কে কে বুঝেছ আর কে কে বোঝোনি বলো।’
বিনয়বাবুর কথা শুনে সবাই চুপচাপ থাকে।
সুরভিকে দাঁড়াতে বলেন, ‘এর পরে কী হবে বলো।’
সে কিছুটা বলে থেমে যায়।
তারপর আরেকজন। এভাবে সবাইকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন। পরে রাগান্বিত স্বরে বলেন,‘এরপরে যে বোর্ডে এসে অঙ্ক করতে পারবে না তাকে বেঞ্চের উপরে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখব।’
স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া করে ইলা অঙ্কের বইখাতা নিয়ে বিনয়বাবুর কাছে গেলে বলেন,‘এখন থেকে আর বিকালে পড়াব না, সন্ধ্যার পরে পড়াব।’
ইলা বইখাতা গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলেন,‘চলে যখন এসেছ, আজ পড়িয়ে দিচ্ছি।’
তার কথা শুনে ইলা শীতলপাটি বিছিয়ে পড়তে বসে। মাস্টার মশাই ওর অঙ্কের বইটা নিয়ে উলটে পালটে দেখতে থাকেন। ওর বইয়ের পৃষ্ঠায় লাল-নীল কলম দিয়ে বিভিন্ন জিনিস আঁকা রয়েছে। কখনও ফুলের পাপড়ি আঁকা, আবার হিজিবিজি করে কিছু লেখা। অন্য বইয়ের পেজের ভেতরে ময়ূরের পালক রাখা। একটার পর একটা বইয়ের পৃষ্ঠা উলটাতেই আছেন। উলটাতে উলটাতে দেখেন একটা বইয়ের পেজে জবাফুল আঁকা আর সেই ফুলের পাপড়িতে ‘ই’ লেখা।
বইটা রেখে দিয়ে বলেন,‘যে যত ম্যাথ বুঝবে সে তত অন্য সাবজেক্টে ভালো করতে পারবে। ম্যাথ হলো আদি সৃষ্টির জ্ঞান। ম্যাথ দিয়ে জগৎ সৃষ্টি। সো অ্যারিথমেটিক বলো আর এলজেবরা বলো যেটা চাচ্ছে সেটাকে মাথায় রেখে ম্যাথ শুরু করতে হবে। ব্যস, ম্যাথ হয়ে গেল। ম্যাথকে অনেকভাবেই করা যায়। ম্যাথ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তবে যতই ভালো করো,ম্যাথে নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায় না।’
ইলা বলে, ‘স্যার, এজন্যই আমার ম্যাথ ভালো লাগে না।’
‘ভালো যে লাগে না সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ম্যাথ ছাড়া পাশ করবে কীভাবে?’
‘টেনেটুনে কোনোরকম পাশ করলেই হবে।’
‘কীভাবে পাশ করলে হবে?’
‘টেনেটুনে পাশ স্যার।’
‘টেনেটুনে পাশ মানে কী?’
‘ধরেন স্যার…’
‘ধরলে আবার বড়ো হয়ে যাবে।’
‘বুঝিনি স্যার!’
‘ঠিক আছে, বলো তুমি কী বলতে চাইছিলে।’
‘কী যেন বললেন স্যার?’
‘তুমি যেটা বলতে চেয়েছিলে সেটা বলো।’
‘না স্যার, পাশ করার বিষয়টা।’
‘ঠিক আছে, বলো।’
‘স্যার, আমি কয়েকটা সম্পাদ্য, উপপাদ্য, গোটা বিশেক পাটিগণিত, ত্রিশ-চল্লিশটা বীজগণিত মুখস্থ করে ফেলি।’
‘যদি সেগুলো পরীক্ষায় না আসেতখন?’
ইলা তার সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিবে বলে, ‘আসবে স্যার। আপনি জানেন না স্যার, আমাদের স্কুলে অনেকে এভাবে পাশ করেছে।’
‘তাই নাকি! জানি না তো।’
‘ধুত্তোরি!’ ইলা মাথায় টোকা দিয়ে বলে,‘স্যার, আপনি বলে দেন কোনটাকোনটা মুখস্থ করব।’
‘ম্যাথ মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। বরং তোমার জন্য একটা সাজেশন তৈরি করে দিই। সেগুলো প্র্যাকটিস করতে থাকো।’
‘ঠিক আছে। সেটাই করে দেন।’
‘যাও, আজকে ছুটি।’
ছুটির কথা শুনে ইলা বইখাতা গুছিয়ে চলে যায়।

ইয়েল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট,রুয়েট,কুয়েট,চুয়েট-সহ বেশ কয়েকটা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা শেষ করে সাড়ে পাঁচ মাস পরে বাড়িতে আসে। বাড়ি ফিরতেফিরতে ওর সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাড়ি এসেই তাড়াহুড়ো করতে থাকে। ওর ভেতরে বেড়ে যাচ্ছে অস্থিরতা।
ওর অবস্থা দেখে মা বলেন,‘আস্তে আস্তে করে খা। তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেন ট্রেন ছুটে পালাচ্ছে।’
‘আমার জন্য বন্ধুরা অপেক্ষা করে আছেমা।’
‘একটু পরে গেলেও কিছু হবে না। কতদিন পরে বাড়িতে আসলি। একটু আরামটারাম করবি, তা না করে ছুটে পালাচ্ছিস। তোর বন্ধুরাই সব। আমি কিছু না?’
‘ও-কথা বলছ কেন মা? তুমি আমার মা। তুমি আমার জীবন।’
মা ওর পাতে আরেকটু ভাত দিতে গেলে বলে, ‘আর খাবো না, মা।’
‘কী খেলি? কিছুই তো খেলি না। ওটুকু খেলে পেট ভরবে? আরেক চামচ ভাতদিই?’
‘না মা, পেট ভরে গেছে’, বলে থালে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে মুখ মুছে বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে ইলাদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন রাতের আঁধার নেমে এসেছে। রাস্তায় তেমন কোনো লোকজন নেই। কাঁচা রাস্তা। কোথাও কোথাও একটু আধটু থলথলে কাদা। কাদা পেরিয়ে ইলাদের বাড়ির উঠোনে পৌঁছে টিউবওয়েলে হাত-পা ধুয়ে নেয়। মাস্টার মশাই আর আবু কথা বলছেন রাস্তার পাশে। কিছু সময়ের জন্য নারকেলগাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সে। তারপর দুইজন দুই দিকে চলে গেলে ইয়েল পা বাড়ায় সদর দরজার দিকে।
ইলাদের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। ভেতরে ঢুকে আস্তে করে ইলার দাদির ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকে দেখে দাদি বাটা থেকে পান বের করে চুন লাগাচ্ছে।ঘরের ভেতরে পা দিয়েই বলে,‘দাদি।’
‘ওহ্ ইয়েল? কখন এলি রে ভাই? আয়, আমার কাছে বস।’
ইয়েল দাদির কাছে গিয়ে বসে।
‘চোখমুখ শুকনা দেখাচ্ছে কেন তোর? তোর মা কিছু খেতে দেয়নি? বস, খাবার দিতে বলি। কই রে কাজলা, ইয়েলকে খেতে দে।’
ভেতর থেকে ইলার বড়ো বোন কাজলা বলে, ‘হাতের কাজটা শেষ করে দিচ্ছি।’
কিছুক্ষণ পরে নারকেল ও চিড়ার লাড্ডু নিয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই বলে, ‘ইয়েল, কখন এসেছ?’
‘সন্ধ্যার আগে, মাইজি।’
‘যাবার সময় আমার সাথে দেখা করে যেয়ো।’
তখন কাজলারসবে বিবাহ হয়েছে। ওর স্বামী ছিলেন স্কুলমাস্টার। এক বর্ষার সন্ধ্যাবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন জমির আইল দিয়ে। এক সর্বনাশা সাপ এসে পায়ে কামড় দিয়ে বসে। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে ওঝা ডেকে আনা হয়। সারা রাত ধরে ঝাড়ফুঁক চলে। কিন্তু কিছুতেই বিষ নামানো গেল না। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেইমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কাজলার সব শেষ হয়ে যায়। এসময়ে কাজলা সন্তানসম্ভবা ছিল। পাঁচ মাস পরে সেটাও পৃথিবীর আলোর মুখ দেখল না। সে হয়ে যায় একা,নিতান্ত একা।
ইয়েলের বয়স তখন দুই বছর। ইয়েল কিছুতেই গরুর দুধ খেতে চাইত না। কাজলা সাদা শাড়ি পরে ইয়েলের সামনে গেলেই ওর মা বলতেন দুধ না খেলে জিনপরিতে নিয়ে যাবে। সেইজিনপরির কোলে বসে দুধ খাওয়া শুরু। এভাবে ইয়েল আস্তে আস্তে কথা বলা শুরু করে।কাজলা তাকে বলত,‘আমি কে?’
ইয়েল বলত,‘জিনপরি।’
‘ওটা কে?’
‘মা।’
আবার কাজলা বলে,‘আমি কে?’
ইয়েল তখন ওর মায়ের দিকে তাকাত।ওর মা তখন বলতেন,‘আমি মা আর সে হলো মাইজি।’
সেই যে শুরু হলো‘মাইজি’ বলা, আজও বলে। কাজলা কখনও মাংস খেতো না। ইয়েল সাদা পলিথিনে লুকিয়ে ওর মাইজির জন্য রান্না করা মাংস নিয়ে গিয়ে খাওয়াত। ইয়েলের জন্মের পাঁচ বছর পরে ইলার জন্ম হয়। কাজলা তখন ছোটো বোনের নাম রাখে ইলা।
ইয়েলের মনে পড়ে যায় শৈশব, কৈশোর, মাইজির কথা। মাইজির গায়ের গন্ধ আর ইলার গায়ের গন্ধ ওর কাছে একইরকম মনে হয়। ‘জি মাইজি’ বলে কাজলার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কাজলা বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরে চলে যায়।
‘দাদি, ইলা কই?’
‘মাস্টার মশাইয়ের ঘরে পড়ে। আরেকটু পরেই চলে আসবে। তুই আমার কাছে বসে ঢাকার গল্প বল।’
বদি পাগলা এদিক-ওদিক দৌড়ায় আর বলেঅল্প মাইরে বিছানা গরম। আরও কত কী বলে আর রাস্তার এক মাথা থেকে আরেক মাথা দৌড়ায়। মাঝে মাঝে বাতাস খাবো, বাতাস খাবো বলে। কিছুক্ষণ পরে ইলাদের উঠোনের উপরে এসে আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলেবাতাস খাবো, বাতাস খাবো। কেউ যদি বলে, ইমরান ডাক্তার ইনজেকশন দেবে, তখন দৌড়ে গিয়ে গাছকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কেউ দিলে খায়, না দিলে ওভাবেই অনাহরে কেটে যায় তার দিনরাত।
দাদি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে শুধু ইয়েল-ইয়েল করে বেড়ালো বদি পাগলা। তোকে দেখতে না পেয়ে এখন আর ইয়েল ইয়েল করছে না। যতদিন ছায়া তততিন মায়া রে দাদুভাই।’
কথা শেষ হতেনাহতেই ইলা ঘরে ঢুকেই বলে, ‘দাদি ক্ষুধা লেগেছে, খেতে দাও।’
ইয়েলকে দেখামাত্র ওর হাত থেকে বইখাতা গড়িয়ে পরে মেঝেতে। নিমীলিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে। আর ইয়েল জড়োসড়ো হয়ে খাটের উপরে বসে থাকল।
ইলার দাদি পিতলের বাটা থেকে পান বের করে তাতে সুপারি, জর্দ্দা দিয়ে চুন লাগিয়ে ঠুস করে মুখে ভরে দিয়ে বলেন,‘আগের মতো পানে স্বাদ নেই ইয়েল। পাহাড়ি পান পেলে নিয়ে আসিস তো। পাহাড়ি পান কেমন লাগে খেয়ে দেখব।’
তারা বাস্তবে নেই। অলীক স্বপ্নে প্রবেশ করে ঝলমলে রঙের ভেতর ডুবে গেছে। শুকনা পাতা ঝরে গিয়ে নতুন সাজে সবুজ পাতায় শীতল বাতাসের মন মাতানো নৃত্যের ছন্দে অন্তরে দোলা দিয়ে উঠেছে সবেমাত্র। বুকের ভেতর জমে থাকা মান-অভিমান পাওয়া না পাওয়ার হিসেব দৃষ্টি বিনিময়ে মুহূর্তেই পানি হয়ে ঝরনাধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।
ইলা শীতল কণ্ঠে বলে,‘আরে ইয়েলবাবু, কখন এলে?’
ইলার মুখের দিকে চেয়ে বলে,‘সন্ধ্যার সময়।’
‘না ডেকে এতক্ষণ বসে আছ যে?’
‘তুমি পড়ায় ব্যস্ত ছিলে তাই।’
‘একদিন না পড়লে কিচ্ছু হয় না। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’
‘ভালো। বেশ ভালো।’
‘এর পরের প্লান কী?’
‘আপাতত কোনো প্লান নেই। কয়েকদিন মড়ার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাব। এখানে-সেখানে যাবো আর সারা রাত জেগে গল্প-উপন্যাস পড়ব।’
‘ভালো। খুব ভালো।তারপর?’
‘ভর্তির রেজাল্ট বের হলে ভর্তির জন্য আবার ছুটতে হবে।’
ইলার দাদি বলেন,‘আর কতদিন লাগবে পড়া শেষ করতে?’
‘ভর্তিই হলো না, আর তুমি বলছ কতদিন লাগবে। আগে তো ভর্তি হোক।’
‘অত দূর থেকে এসেছিস, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দে।’
‘আচ্ছা’,বলে ইয়েল রুম থেকে বের হলে ইলাও পেছন পেছন বের হয়ে এসে বলে,‘আগামীকাল সকালে স্কুলের পেছনে এসো। অনেক কথা জমে আছে।’
‘কোথায় জমে আছে?’
ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে বলে,‘এখানে। বুঝলে?’
ইয়েল উঠোনের নিচে আর ইলা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়েল ঘুরে গিয়ে বলে,‘এখন বলো।’
‘এখন বলা যাবে না।
‘কখন বলবে তাহলে। আমার যে শুনতে ইচ্ছে করছে।
‘আচ্ছা, স্কুল শুরু হওয়ার আগে এসো।’
‘কোথায় আসব?’
‘স্কুলের পেছনের সাইডে।’
‘কয়টায় আসব?’
‘সাড়ে ৮টার ভেতরে।’
ইলা ঘুরতেই দেখে মাস্টার মশাই পেছেনে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘ঠিক আছে’, বলে ইয়েল উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসতেই দেখে বদি পাগলা নারকেলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। না দেখার ভান করে সে হাঁটা শুরু করে। বদি পাগলা নারকেলগাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেই ইয়েলের হাত খপ করে ধরে ফেলে।
‘কী রে কোথায় থেকে উড়ে আসলি?’
‘বাতাসে ভেসে।’
‘আগের স্বভাব এখনও যায়নি?’
‘যাবে কী করে? আমার একটা দায়িত্ব আছে না?’
‘তোর আবার কীসের দায়িত্ব?’
‘জিনিসগুলোকে আগলে রাখা।’
‘ওহ্! তাই বুঝি?’
‘জানো ফুলের মালী কখনও ফুলের মালা গলায় পরতে পারে না? যত্ন করে একজন, ফুলের সৌরভ নেয় আরেকজন।’
‘তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝি না?’
সহজভাবে বলি,‘হালচাষ যখন শুরু করেছ, বীজ বপন শুরু করো। নিজের ফসল নিজের ঘরে নিয়ে যাও।’
‘কীসব আবোলতাবোল বলিস?’
‘ফল পেকে গেলে ঝরে পরে মাটিতে। অন্যজন ভাগ বসায়।’
‘তোর মাথামুণ্ডু ঠিক আছে?’
‘আলবাত আছে।’
‘সারাটা দিন কিছু খাসনি মনে হচ্ছে।’
‘আর বলো না। বাগান থেকে দুটো পেয়ারা পেড়ে ফিরে দেখি মুকুল সরকারের মা পেছনে দাঁড়িয়ে। অমনি ফেলে দিয়ে দৌড়।’
‘চল, আমার সাথে খাবি।’
‘না গো ভায়া, তোমাদের বাড়িতে অনেক লোকজন।’
‘তাতে কী হয়েছে? চল আমার সাথে।’
‘অত লোকের ভিড়ে আমার ভালো লাগে না।’
‘সারা রাত না খেয়ে থাকবি?’
‘বাতাস খাবো, আলো খাবো।’
‘আলোবাতাস ভালো জিনিস। চল তোকে বাতাসের সাথে জ্যোৎস্নার মিক্সার খাওয়াব।’
ইয়েল চলা শুরু করলে বদি পাগলা পেছেন পেছন আসতে থাকে। সোহেলের দোকানের বানরুটি কিনে চাঁদের দিকে কিছুক্ষণ ধরে রাখে। কাপে চা নিয়ে কলাপাতা দিয়ে বাতাস করে বলে,‘চাঁদের জ্যোৎস্না আর বাতাস মিক্সার হয়ে গেছে। এবার খা,ভালো লাগবে।’
বদি পাগলা খেয়ে বলে, ‘দারুণ স্বাদ হয়েছে ভায়া। তুমিও একটু খাও।’
‘তুই খেয়ে আমার কাছে চলে আসিস।’
সে দুদিকে মাথা দোলায়।
বাড়ি গিয়ে ইয়েল দেখে ওর বোনরা এসে হাজির। খাওয়াদাওয়া করে গল্প করতে-করতে প্রায় সকালের কাছাকাছি। তারপর সবাই ঘুমাতে যায়।
ইলা সাড়ে ৮টা থেকে ওর জন্য স্কুলের পেছনে অপেক্ষা করতে থাকে। ইয়েলের ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ইয়েল না যাওয়াতে ইলা দেরি করে ক্লাসে ঢোকে।

ভর্তির রেজাল্ট বের হলে ইয়েল ভালো কোনো সাবজেক্ট পেল না। কোনোরকমে রসায়নে টিকে। এখবর পৌঁছে যায় সবার কানে। ইয়েল ভেঙে পড়ে রেজাল্টের খবর শুনে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আরও এক বছর অপেক্ষা করবে? ঘরের ভেতরে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। ইদানীং কোথাও বের হয় না। কারও সাথে কথাও বলে না। খাওয়ার সময় হলে খেয়ে আবার ঘরে ঢুকে আর বের হয় না।
খবর শুনে ইয়েলকে ডেকে পাঠায় ইলা। সে তবু আসে না। বেশ কয়েকবার ডেকে পাঠালেও আসেনি। শেষ পর্যন্ত বদি পাগলাকে দিয়ে ডেকে আনার চেষ্টা করে। তবুও সে আসলো না। এক পর্যায়ে ইলা ওদের বাড়ি গিয়ে রুমে ঢুকে দেখে সে খাটের উপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ওর শরীরে স্পর্শ করতেই চোখ তুলে তাকায়। ইলাকে দেখে সে বিস্মিত হয়।
‘অমন হাঁ করে কী দেখছ?’
‘কিছু না।’
‘তাহলে আমাকে দেখে অমন করে আছ কেন?’
ইয়েল কিছু না বলে চুপ হয়ে তাকে। পরে দুচোখ বন্ধ করে নেয় সে।
‘ডেকে পাঠালাম আসলে না যে?’
‘যেতে ভালো লাগছিল নাতাই।’
‘কী হয়েছে সেটা বলো আমাকে।’
‘বলার তেমন কিছু নেই।’
‘অবেলায় শুয়ে আছ কেন?’
ইলার কথার কোনো উত্তর দেয় না। পাশ ফিরেচুপ করে থাকে।
ইলা আবার বলে,‘মন খারাপ?’
ইয়েল কিছু বলে না।
‘আরে বাবা! যা হয়েছে তা ভালোর জন্যই হয়েছে মনে করো। নিয়তির উপরে কারও কোনো হাত থাকে, বলো? তুমি সুদর্শন, চঞ্চল একটা ছেলে। সারা গ্রাম মাৎ করে রাখবে তা নয়, মনমরা হয়ে ঘরেবন্দি হয়ে আছ। এটা কেমন দেখায় বলো? চলো আলোতে চলো। পুকুরপাড়ে বেশ বাতাস বইছে। বাতাসে গেলে তোমার ভালো লাগবে।’
‘ইলু, তুমি বাড়ি যাও। আমি কোথাও যাবো না।’
‘তুমি বাইরে না গেলে আমার মন খারাপ হবে।’
‘কেন এসেছ এখানে? আমাকে একা থাকতে দাও।’
‘আমাকে ছেড়ে একা থাকবে?
এবারও ইয়েল কিছু বলে না।
‘আমি এমনিএমনি আসিনি তোমার কাছে। আমি এসেছি তোমাকে জাগ্রত করতে। তোমার ভেতরের আগুনটা জ্বালাতে।’
‘আমাকে দিয়ে কিছু হবে না,বুঝলে?’
‘কে বলেছে হবে না? ঘরে বসে থেকে তুমি কী করবেশুনি?’
‘আমার মন খারাপ।’
‘বা রে! তোমার মন খারাপ হলে আমার বুঝি ভালো লাগে? চলো। না গেলে কান্না শুরু করব কিন্তু।’
‘তোমাকে নিয়ে পারা যায় না, বুঝলে? তুমি যাও, আমি পরে আসছি।’
‘তা হবে না। আমরা একসাথে বের হবো।’
‘আমি তো কাঁথার ভেতরে। আমার লুঙ্গিটা যে কোথায় কে জানে।’
‘তুমি না ভীষণ খারাপ!’
ইলা খাটের পাশ থেকে লুঙ্গিটা তুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ায়। ইয়েল সেটা পরে কাঁথার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তখনই ‘ধরধর’ শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ইলা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে বদি পাগলা দৌড়াচ্ছে আর তার পেছন পেছন কতগুলো ছেলে ছোকরা ধরধর বলে চিৎকার করে যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি করে ইলা বলে, ‘দ্রুত বের হও।’
ইলার কথা শুনে ইয়েল ঝড়ের গতিতে বের হয়ে দেখে বদি পাগলাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। ইয়েল দৌড়ে গিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েতাকে বুকের সাথে জাপটে ধরে।
‘আরে-আরে, কী হচ্ছে এসব!’
জনতার মধ্যে থেকে সেতু বলে, ‘ইয়েল তুই সরে যা। তাকে আজ মেরেই ফেলব।’
‘পাগলের সাথে তুইও পাগল হয়েছিস? ছাড়! তাকে ছেড়ে দে। একদম সামনে এগুবি না।’
ইয়েলের কথা শুনে সবাই থমকে যায়। সবাই আস্তে করে সরে যায়। ইয়েল বদি পাগলার হাত ধরে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ইলাও আসে সেখানে।
‘কি রে কী হয়েছিল?’
বদি পাগলা কোনো উত্তর দেয় না।
‘বল, কেন তোকে ওরা মারছিল?’
‘কলা পেড়ে খেয়েছি তাই।’
‘তোকে না কতবার বারণ করেছি। তারপরও…!’
‘ভুক লাগলে কী করব?’
‘আমার কাছে চাইতে পারতিস।’
‘ভুক লাগলে কি আর মাথা কাজ করে? সব ওলটপালট হয়ে যায়।’
‘যা, আমার ঘরে খাবার আছে। গিয়ে খেয়ে ফেল।’
‘তুমি চলো।’
‘তুই যা, পরে যাবো আমি।’
বদি পাগলা খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে চলে যায়। ইলা আর ইয়েল পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে।
ইয়েলের দিকে তাকিয়ে ইলা বলে, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘কই কিছু না। কী হবে আবার?’
‘মিথ্যে বলো না।’
‘সত্যি বলছি। তেমন কিছু না।’
‘কেউ না জানুক আমি জানি। আমার চাইতে তোমাকে কে বেশি চিনে, কে বেশি জানে বলো? কবে ভর্তি হচ্ছ সেটা বলো।’
‘আরও এক বছর অপেক্ষা করব।’
‘তুমি পাগল নাকি? কেউ সময় নষ্ট করে? এসময় আর তুমি ফিরে পাবে? সময়কে ধরে রাখা যায় না ইয়েল।
‘ভালো সাবজেক্ট পাইনি তাই আরও এক বছর অপেক্ষা করে দেখব।’
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে ইলা বলে, ‘নিয়তির উপর কারও হাত থাকে? খোদা যা করে তা ভালোর জন্যই করে। খোদার ফয়সালা আসমান-জমিনে সবচেয়ে সৌন্দর্যময়।’
ইলার কথা শুনে ইয়েল ওর দিকে চোখ তুলে তাকায়।
ইলা দুচোখ বন্ধ করে বলে, ‘আমার মন, আমার অন্তর, আমার হৃদয় বলছে এই সাবজেক্টই তোমার জন্য শুভকর। এতেই তোমার মঙ্গল বলে আমার মনে হচ্ছে।’
‘কী করে বুঝলে তুমি?’
‘তুমি একান্ত নিজের সাথে কথা বলে দেখো। তোমার আত্মা, তোমার মন, তোমার হৃদয় কী বলে?’
‘আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না।’
‘সায় দেবে। শান্ত হও,নির্মল হও। আত্মাকে জাগ্রত করো। একটু সময় নিয়ে ওটার উপর মনোনিবেশ করো। দেখবে ঠিক কেযেন চুপিচুপি তোমার সাথে কথা বলে চলেছে।’
‘বাহ! ভালো বলেছ। একটু ভাবতে দাও।’
‘কোনো ভাবার দরকার নেই। আগামীকাল ভর্তির জন্য ঢাকা চলে যাও।’
‘আর তুমি?’
‘আমি মানে কী? আমাকে নিয়ে যেতে চাও?’
‘হ্যাঁ চাই।’
‘অনার্সটা পাশ করো। আর এর মধ্যেই আমি এসএসসি পাশ করে ফেলব। তখন না হয় সেসব চিন্তা করা যাবে।’
‘কমিটমেন্ট করো।’
‘নতুন করে আবার কী কমিটমেন্ট করব? তুমি তো আমার সব।’
‘তুমি এসএসসি পাশ করলে ঢাকায় ভর্তি হবে?’
‘আগে সেখানে তুমি থিতু হও। তুমি যেখানে আমিও সেখানে।’
এসময় গ্রামের ছেলে ছোকরারা দল বেঁধে ওদের দিকে আসতে থাকে। তাদের আসতে দেখে পুকুরপাড় দিয়ে ওরা দুজন দুদিকে চলে যায়।
সেতু দ্রুত কাছে চলে এসে বলে,‘কী রে ইলা, চলে যাচ্ছিস যে? তোদের গল্প শেষ?’
ইলা কোনো কিছু না বলে চলে যায় আর ইয়েল পুকুরের মাছকে কলাপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে দিতে থাকে।

শেষমেশ ভর্তি হতে হলো তাকে রসায়ন সাবজেক্টে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আবার সেই আগের মেসে গিয়ে ওঠে। এক বছর পার হয়ে গেছে। কত ঘটনা ঘটে যায় সময়ের পালাবদলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ইয়েল আস্তে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে ফুটেওঠে। ইলার কথাই তার কাছে সত্য বলে মনে হতে থাকে। কোনো কিছুর অভাব বোধ করলে ওর কথা ভীষণ মনে পড়ে। ইস! যদি কাছে থাকত তবে বেশ ভালো হতোমনেমনে ইয়েল ভাবতে থাকে। অতি দ্রত সব আয়ত্ব করে ফেলে। ক্লাসমেটদের সমস্যায় সবার আগে ইয়েল থাকে। ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে ইয়েলময়।
ইলা এবার ক্লাস টেনে ওঠে। সামনে তারএসএসসি পরীক্ষা। মাঝেমাঝে তাদের চিঠির আদানপ্রদান চলে।পরীক্ষার পড়ার চাপের কারণে ইয়েলেরগ্রামে যাওয়া হয় না বললেই হয়। ওদের এখন একমাত্র ভরসা চিঠি। সরাসরি চিঠি ইলার নামে দেওয়া যায় না। চিঠি যায় বিপুর নামে। সে চিঠি পেয়ে ইলাকে দিয়ে আসে। এভাবেই চলে তাদের আলো-অন্ধকারের জগৎ।
আস্তে-আস্তে করেইলার দিকে ঝুঁকে পড়েন বিনয়বাবু। প্রথম দেখায় তাকে ভালো লেগে যায়। ইলা বিষয়টা বুঝতে পেরে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তবে বিধির লিখন খণ্ডন করবে কে? এক বছর সাত মাসের মাথায় বিনয়বাবুর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল (রাজশাহী)-এ সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি হয়ে যায়। বিনয়বাবু পালপুর স্কুল ছেড়ে রাজশাহী চলে আসেন। প্রথম মাসের প্রথম বেতন পেয়ে হরেকরকমের দই, মিষ্টি, ফলমূল, ইলিশমাছ নিয়ে ইলাদের বাড়িতে হাজির। সবগুলো ওর দাদির কাছে দিয়ে ইলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ইলার খোঁজ করতেকরতে গিয়ে দেখেন এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। বিনয়বাবু ঘরে গিয়ে বলেন, ‘ওহ্, তুমি এখানে?’
ইলা কোনো কথা না বলে বাইরে তাকিয়ে থাকে।
বিনয়বাবু অস্থির হয়ে বলেন,‘কী ব্যাপার, মন খারাপ?’
ইলা ঘুরে বসে বলে, ‘না, তেমন কিছু না স্যার।’
‘তাহলে মুখ ভার করে কেন বসে আছ?’
‘কী করে যে বলি স্যার, বুঝতে পারছি না।’
বিনয়বাবু উদ্বেলিত হয়ে বলেন, ‘আমার সব কথা তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বলতে গিয়েই বলা হয়নি। তুমি কি আমার বুকের ভেতরে জমানো কথা শুনতে চাও?’
তার কথা শোনামাত্র ইলা হতচকিত হয়ে ওঠে। সেও তার জমানো কথা, কষ্টের কথা বলতে গিয়ে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়। ইয়েল তো আজ সকালে চলে গেছে। ওর নীরবে চলে যাওয়া দেখেছে আজ সে।
আবার বিনয়বাবু বলেন, ‘কী হলো, কিছু বলো।’
ইলা বুকে সাহস সঞ্চয় করে।‘ইয়েল আজ সকালে ঢাকা চলে গেছে। ওর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে’, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘যে যাবে তাকে চলে যেতে দাও। হাতের কাছে যাকে পাবে তাকে নিয়ে ভাবনা মিলাও।’
বিনয়বাবুর কথা শুনে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে চুপসে গিয়ে শান্তহয়ে যায়। কী বলবে তার কোনো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
এমন সময় আবার বিনয়বাবু বলে বসেন, ‘ইয়েল কোন সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছে?’
‘রসায়নে।’
‘এটা কোনো সাবজেক্ট হলো? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে হতে পারল না। ওসব পড়ে চাকরিবাকরি কিছু হবে না।’
বিনয়বাবুর কথা শুনে ইলা তখন নড়েচড়ে বসে। ওর মুখের কারুকার্য দেখে বিনয়বাবু বুঝে নিলো ইলা তার কথায় খুশি হয়নি। তারপরও এটা-সেটা বলে যেতে থাকল। অবিশ্বাসের বীজ পোঁতা হয়ে গেছে। এখন শুধু একটু একটু করে সার-পানি দিয়ে বড়ো করে তুলতে হবে।এ সুযোগে ওর বড়ো বোন কাজলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব শুনে বিনয়বাবুকে কোনো কথা না দিয়ে ভেবে দেখবে বলে আশ্বস্ত করে।
ইলার পরিবার এরকম ভালো ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে চায় না। প্রস্তাবটি তারা মেনে নেয়। বেঁকে বসেনইলার দাদি। তিনি যদিও পরিষ্কার করে কিছু বলেননি তবুও তিনি মন থেকে সায় দিলেন না।
দাদি ইলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ইয়েলের বিষয়ে। ইলা বলে,‘তোমরা যেটা ভালো মনে করো সেটাই আমি মেনে নেবো।’
‘তাহলে ওর কী হবে? অবুঝ ছেলে সে। কী নিয়ে বাঁচবে? তার কথাও তো বিবেচনা করতে হবে তোকে।’
ইলা কিছু না বলে চুপ হয়ে যায়। পরে বলে,‘সে কবে পড়াশোনা শেষ করবে, কবে চাকরি পাবে, তারপর আমাকে বিয়ে করবে। আর ততদিনে আমি পেকে ঝুনা নারকেল হয়ে যাবো।’

অবশেষে কিছুদিন পর বিনয়বাবুর সাথে ইলার বিয়ে হয়ে যায়। ইলার বিয়ের খবর ইয়েলকে কেউ জানায়নি। ইয়েল প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেই গ্রামে আসে। যাওয়ার সময় রাস্তায় দেখা হয় রিপনের সাথে।
‘রিপন, কী খবর রে?’
‘হুম ভালো। খুব ভালো।’
‘সব ঠিক আছে তো?’
‘হুম। তবে একটা ছাড়া।’
‘সেটা আবার কী?’
‘আমাকে একটা সিগারেট খাওয়া, তারপর বলব।’
‘জানিস না আমি ওসব ছাইপাঁশ খাই না?’
‘এখন কত কী খাবি রে পাগলা!এখন শুধু খাওয়ার সময়। আয় একটা সুখটান দিয়ে যা।’
‘কী রে,কিছু বললি মনে হয়?’
‘তেমন কিছু না। বাসায় যা, রাতে আসিস, কথা বলব।’
ইয়েল বাসার দিকে যেতে শুরু করে। কিছুদূর অতিক্রম করেছে মাত্র। গ্রামের সবার সাথে দেখা হলেই কুশল বিনিময় করে। সবাই কেমন যেন চুপচাপ মনমরা হয়ে আছে। বাতাসটাও একেবারে গুমোট রূপ ধারণ করেছে। অনেকেই জিজ্ঞাসা করে,‘কখন এলে? শরীর ভালো? কেমন আছ? অসুখবিসুখ হয়নি তো? কেউ কেউ ওর দিকে চেয়ে থাকে। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সবার আচরণ কেমন কেমন মনে হয়। গ্রামে পা দিয়েই ওর কেমন যেন মনে হচ্ছে। আবার তা প্রকাশও করতে পারছে না। অসহ্য ব্যথা বুকের ভেতরে। মনের অজান্তে ওর আত্মা খাঁ-খাঁ করে ওঠে। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে। সে বুঝতে পারেকিন্তু কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছে না।
অনেক দূর থেকে বদি পাগলা দৌড়ে এসে বলে, পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।শুধু দৌড়ায় আর বলে,পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।বদি পাগলা ইয়েলকে দেখে দৌড় দিয়ে কাছে এসে বলতে লাগে,পথহারা পথিক তুমি,পথ হারিয়েছ অধিক তুমি।বারবার এভাবে বলতে থাকে পাগলা।কী যেন একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তারউপর দিয়ে।যতবার জিজ্ঞাসা করে ততবারই বলে, পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।
কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারে না ইয়েল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইমরান ডাক্তারের বাড়ির কাজের মেয়ে ফুলনিকে বলে,‘বদি পাগলার কী হয়েছে রে? তুই কিছু জানিস? কীসব আবোলতালোব বলছে।’
ফুলনি আমতা আমতা করে বলে,‘ভাইজান, কাউরে বলবেন না একটা গোপন কথা বলি আফনারে।ইলা আফার বিয়ের লগে লগে এমন করতাছে।’ বলেই সে কেঁদে ফেলে।
ফুলনির কথা শুনেই ইয়েল সবকিছু ঝাপসা দেখা শুরু করে। ওর হাত থেকে ব্যাগ মাটিতে পড়ে যায়। ধপাস করে মাটির উপরে বসে পড়ে। ইয়েল আর চলতে পারে না। কে যেন পেছন থেকে ধরে রেখেছে। পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে যায়।
বদি পাগলা বলতে লাগল,পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।আর ফুলনি ডাকতে লাগল,‘ভাইজান! ভাইজান! কী হইছে আপনার?’
সেআর উঠতে পারে না।
ফুলনি এবার জোরে জোরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল,‘ভাইজান উঠেন, উঠেন!’
আর বদি পাগলা বলেই চলে,পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।
ফুলনি ইমরান ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে,‘খালুজান! ও খালুজান! সর্বনাশ হইয়া গেছে। ইয়েল ভাইজান যেন কেমন করতাছে। জলদি কইরা আসেন।’
ফুলনির চিৎকারে ইমরান ডাক্তার দৌড়ে আসেন। আরও সব লোকজন দৌড়ে আসে।ইয়েল মাটিতে পড়ে আছে। আর বদি পাগলা ঘুরে ঘুরে বলে,পথহারা পথিক আমি,পথ হারিয়েছি অধিক আমি।ইমরান ডাক্তার বলেন,‘হারামজাদা দূর হ!’সবাই ধরে তাকে বৈঠকখানায় নিয়ে যায়। ফুলনি ওর বাসার দিকে দৌড় দেয় ইয়েলের মাকে ডাকার জন্য। বদি পাগলা নেচে নেচে বলতে থাকে, বাতাস খাবো, আলো খাবো। আহা রে জীবন! আহা রে পৃথিবী! ভবের মায়ায় পড়ে রইছি।
খবর শোনামাত্র যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই ইমরান ডাক্তারের বাড়ির দিকে আসতে থাকে। মুহূর্তেই কয়েকশ লোক জমায়েত হয়ে যায় ডাক্তারের উঠানে। অনেকে আবার ইয়েলদের বাসায় গিয়ে না পেয়ে ফিরে আসে। রওনা দেয় ইমরান ডাক্তারের বাড়ির দিকে।
কেন এমন হলো?কেউ কেউ মনে করছে ইলার বিয়ের খবর শুনে এমন হয়েছে। আবার কেউ বলে বদি পাগলার ভয়ে এমন হয়েছে। কতজনের কত কথা, কত মন্তব্য। যে যা পারে বলে চলে। ইমরান ডাক্তার ইয়েলেরমাথায় পানি ঢালেন আর প্রেসার মেপে দেখেন। কেউ পাখা দিয়ে বাতাস করে। কেউ গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনে। কেউবা লেবুর শরবত করে আনে।
ইয়েলের মায়ের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এত লোকের সমাগম হয়েছে যে ভেতরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভেতরে যাবার কোনো জো নেই। কেউ সরে যাচ্ছে না। অবস্থা দেখে মসজিদের মাইক দিয়ে মাইকিং করে সবাইকে সরে যেতে বলতে হয়। তিন ঘণ্টা পরে ইয়েল চোখ খুলে তাকালে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। এক নজর দেখার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। কে কার আগে দেখবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় হট্টগোল-হুড়োহুড়ি। অনেকে বলে, আমাদের ইয়েলকে বাঁচাইছ খোদা। হে খোদা, তুমি বড়োই মেহেরবান। তুমি বড়োই দয়ালু। তুমি সবার ডাকে সাড়া দিয়েছ হে খোদা।
দুদিন গত হয়ে গেল। সে ঘর থেকে বের হয়নি। শুয়ে আছে তো আছে। কত লোক দেখতে আসে। গ্রামের মানুষ বলে কোনোকিছু ঘটলে সারা গ্রাম প্রচার হয়ে যায়। পাড়ামহল্লা, চায়ের দোকান, বাড়ির উঠোন সব জায়গায় ইয়েলের গল্প।
পাশের বাড়ির খালা বলে,‘ভালো হয়েছে। তাদের সাথে মিলতনা।’
শেফালি বলে,‘দুই পরিবার বসে সমঝোতা করতে পারত।’
কাবেরী বলে,‘এর ফল ঠিকই পাবে। ছেলেটা অবুঝ। না বুঝে এসবে জড়িয়ে গেছে।’
রোখসানা বলে,‘আমি অনেকদিন দেখেছি পুকুরপাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে। তখন বুঝিনি যে তারা এসবে মত্ত।’
পাশের বাড়ির জেবু বলে ওঠে,‘ইয়েল নিজের পাছা নিজেই ব্লেট দিয়ে ফেড়েছে। এখন কেমন লাগে বুঝুক।’
হাইরে বাঙালি, কত কথা যে বলে! একটা ইস্যু পেলেই হলো,সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ। আরেকটা ইস্যু না আসা পর্যন্ত বুঝি চলতেই থাকবে।
ইয়েলের অবস্থা আগের চেয়ে এখন একটু ভালো। কেউ কিছু বললে কোনো কিছু উত্তর দেয় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুচোখ দিয়ে অশ্রুপাত করে নীরবে। মাঝরাতে বিকট শব্দ করে চিৎকার করে ওঠে। এটাওর জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। রাতে ঘর থেকে বের হয়ে গাছের তলায় বসে থাকে। কখনও কখনও খালি গায়ে তপ্ত রোদে শুয়ে থাক। গোসল, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করে না। ওর চোখ দুটো ভেতরে ঢুকে গেছে। চুল উসকোখুসকো, মুখখানা মলিন। চেহারায় রোগা রোগা ভাব। হঠাৎ কেউ দেখলে ভয় পাওয়ার মতো অবস্থা। বুকের হাড় পর্যন্ত দেখা যায়। যেখানে বসে থাকে তো থাকেই। কেউ ডাকলে কটমট করেতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইলাদের বাসার সদর দরজার সামনে কে বা কারা হাগু করে রেখে যায়। প্রতিদিনই এসব নিয়ে গ্রামে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। এসব নিয়ে গ্রামে দু-দুবার লোকজন বসেছে। লোকজন যখন বসে তখন দুয়েকদিন বন্ধ হয়। কিছুদিন পর আবার শুরু করে। গ্রামের কেউ কেউ সন্দেহ করে বদিপাগলাকে। আবার বলতেও পারে না। সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই ওদের কাছে।
রাত হলেই ইয়েল বের হয়ে যায়। এ-দোকান ও-দোকানে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি যায়। সবাই ওকে নিয়ে মজা করে। জোর করে জিনিস খাওয়ায় সবাইকে। সবার এক কথা,‘ভালো হয়েছে।’সারা রাত ঘুরে শেষ রাতে ফিরে আসে বাড়িতে। কেন এমন করে সে নিজেও জানে না। ওর এগুলো করতে ভালো লাগে। কোনো লেখাপড়া করে না। কারও সাথে মিশে না। কোনো খেলাধুলা করে না। বাড়িতে কেউ এলে কথা পর্যন্ত বলে না। একেবারে চুপচাপ হয়ে আছে। ওর কাজকর্ম করতে ভালো লাগে না। শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। প্রথম বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে, সে খবরও রাখেনি।
ইয়েলের বন্ধু রাফি ওর খোঁজে গ্রামে এসে হাজির। সে এসে দেখে ইয়েলেরখুব খারাপ অবস্থা। রাফি এসেই পরীক্ষার রেজাল্টের খবর দিয়েছে। সে খবরে উল্লাস-উচ্ছ্বাস নেই ওর ভেতরে। কেমন যেন মনমরা আর নীরব হয়ে আছে। ওর জন্য ওর মা কত পির-ফকিরের কাছে থেকে পানিপড়া এনে খাইয়েছে তার অন্ত নেই। এরপরও ভালো হবার লক্ষণ নেই।
রাফি অনেক কষ্ট করে তাকে গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় নিয়ে যায়। সে সন্ধ্যা হলেই চলে যায় চন্দ্রিমা উদ্যানে বা বাংলাবাজারের কোনোখুপরি ঘরে রাত কাটিয়ে ফিরে আসে সকালে। দুহাত ভরে টাকা খরচ করতে থাকে। এসব করতে ভালো লাগে ওর। বন্ধুরা দেখে তো অবাক। হঠাৎ একদিন রাতে স্বপ্নে ইলাকে দেখে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে। সেকি কান্না! কান্নায় আকাশবাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মাঝেমাঝেমেসে না থেকে ফুটপাতে আবার কখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাতের পর রাত পার করতে থাকে। একই শার্টপ্যান্ট পরে দিনের পর দিন পর করে দেয়।
রাতে হালকা একটু বৃষ্টি হয়েছে।ইয়েল বেঞ্চের উপরে শুয়ে আছে। সমস্ত রাত জাগ্রত থেকে রাত পার করেছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে সকালের দিকে কেবল চোখ দুটো লেগে এসেছে। ঘুম ঘুম চোখে দেখে বৃষ্টির পানি লতাপাতার মধ্যে জমে আছে। তার উপরে গাছপালার ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো পড়েইলার অবয়বঝলমলিয়ে ওঠে। এক সেকেন্ড দেরি না করে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গড়াগড়ি করতে থাকে। সে সময় লালন সাধু আক্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখে মাটিকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করার জন্য চেষ্টা করছে। সাধু বাবার ডাকে ইয়েলের চেতনা ফিরে আসলে বাচ্চাদের মতো করে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে।
ইয়েলকে কাঁদতে দেখে সাধুবাবা বিচলিত হয়ে বলেন,‘হে বৎস! কী হইছে তোর, কাঁদিস কেন?’
ইয়েল কিছু না বলে কেঁদেই যায়।
সাধুবাবা ওর দুই বাহু ধরে বলেন,‘আহা রে! কে এমন করছিস বাছাধন?’
ইয়েলের সাথে মাটিতে জমানো পানির উপরে বসে পড়ে ঝোলা থেকে কলকি বের করে টান দিতেদিতে বলে,‘ওই রূপ ওই রশ্মি আত্মার প্রতিকৃতি।’
‘কী করে বুঝলেন সাধুবাবা?’
‘ওরে পাগলা! আমিও যে তোর মতো পথহারা পথিক। নে টান দে। টানে টানে সব দুঃখ-জ্বালা ধোঁয়ার মতো বের করে দে।’
অমনি ইয়েল সাধুবাবার হাত থেকে কলকি নিয়ে সিদ্ধি টানতে থাকে। জোরে জোরে টানে আর আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ওর চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে।
সাধুবাবা বলেন, ‘তোকে দিয়ে হবে রে পাগলা।’
বলে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। ইয়েল তার পেছন পেছন যেতে থাকে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে সাধুবাবা ঘুরে দেখে তাকে সাথে আসতে নিষেধ করেন। তবুও সে যেতে থাকে। সাধুবাবা আবার হাঁটা শুরু করেন। সেও তার পাশেপাশে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ অগ্রসর হওয়ার পর দূর্বাঘাসের উপর বসে পড়ে ইয়েলকে বসতে বলেন। ইয়েল তার মুখোমুখি হয়ে বসে।
‘হে বৎস! আমার সঙ্গ কেন নিলে?’
‘আমি বাউল হবো। আমি সাধু হবো। আমি সন্ন্যাসী হবো। আমি ভবঘুরে হবো।’
‘এ পথ সে পথ নয় রে পাগলা! এপথ বড়োই নির্মম। শুধুই কষ্ট। এ পথে শুধু অলসরা ভিড় জমায়। মাঝপথে এসে কত অলস ছেড়ে গেছে তার সংখ্যাও কম নয়।’
‘সাধুবাবা, আমাকে দীক্ষা দিন। আমাকে সঙ্গে নিন।’
‘হে আমার বৎস! তোর সরলতা, তোর নির্মলতা, তোর হৃদয়ের আকুতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার বিশ্বাস তুই তোর গুপ্তধন খুঁজে পাবি।’
‘কীভাবে সাধুবাবা, বলুন?’
‘সরলতা, সৎচিন্তা আর সৎকর্ম দ্বারা।’
‘আমাকে কী করতে হবে সাধুবাবা?’
‘মনোনিবেশ করতে হবে। যেখানে তোর হৃদয় সেখানেই তোর গুপ্তধন। জয়গুরু যেখানে শান্তি সেখানে।’
‘আমার করণীয় কী গুরুজি?’
‘এখান থেকে দৌড়ে রুমে গিয়ে চল্লিশদিন পর্যন্ত মৌন থাকবি। তারপর হৃদয় যা করতে বলবে তা-ই করবি। পেছন ফিরে তাকাবি না।’
সাধুবাবার কথা শুনে ইয়েল দৌড় দিলো আর তিনি কদম গুনে গুনে হাঁটা শুরু করলেন।
ইয়েল এক রুমে একা একনাগাড়ে চল্লিশ দিন নিজেকে বন্দি করে রাখে আর ইলা-ইলা করতে থাকে। কিছুদিন যেতে না যেতে সে আর ইলা বলে না। এখন শুধু ওর মুখ দিয়ে ইল্লা-ইল্লা বের হতে থাকে। রাফি ওর অবস্থা দেখে বলে, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। রাফি জোর করে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায় তাকে।
ডাক্তার বলেন,‘তেমন কিছু হয়নি। তবে একা একা থাকতে দেবেন না। যেন পুরানো স্মৃতি মনে ভেসে না ওঠে। এক কাজ করা যায়। মেডিটেশন। দুই কান ও দুই চোখ শাট ডাউন করে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারে। এখন তার একটা বিশ্বাসকে পরাজিত করতে আরেকটা বিশ্বাসের প্রয়োজন। আর সেই বিশ্বাসটা হলো অবচেতন মনে প্রকৃতির সাথে কথা বলা। সেটাই হবে তার জন্য খুবই কার্যকরী।’
ডাক্তার সাহেবের সাজেশন অনুযায়ী শুরু করে মেডিটেশন। সিডিতে যত দুঃখের গান, কবিতা,গজল ছিল সবগুলো সরিয়ে ফেলে। সবসময় আনন্দের গান শোনার চেষ্টা করে। ঢাকায় যত পির-দরবেশের মাজার আছে সেগুলোতে গিয়ে প্রার্থনা করে আসে। তেইশ দিনের মধ্যেই উন্নতি লক্ষ করা যায়।
আবার আগের মতো প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে ইয়েল। সেলুনে গিয়ে দাড়িগোঁফ ছেঁটে রাজপুত্র হয়ে যায়। জিন্সের সাদা প্যান্ট, আকাশি এক হাত ফুল অন্য হাত হাফ শার্ট(ইয়েলশার্ট) পরে চলে যায় এখানে-সেখানে। এক-একদিন যায় এক-এক মার্কেটে। ইচ্ছেমতো শপিং করে নিয়ে আসে। নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে প্রতিদিন চায়নিজ খাওয়া। গুলশানের খোশবি রেস্টেুরেন্টের বিরানি সবচেয়ে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে পুরান ঢাকার নীরব হোটেলে খেয়ে আসে। শুধু খেয়েই আসে না। আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিউজ পেপার পড়ত। এখন দুই-তিনটা পত্রিকা রাখে। ওর ভাবসাব অন্যরকম। চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি রেখে রঙিন একুশ ইঞ্চি টিভি বায়তুল মোকাররম থেকে কিনে আনে। টাকাকে তেজপাতা ভাবে। দুহাতে টাকা খরচ করে বেড়ায়। বায়তুল মোকাররম হতে গলার স্বর্ণের চেন, হাতের ব্রেসলেট কিনে আনে। কিছুদিন পরে আরেক কাণ্ড করে বসে। ল্যান্ড ফোন ফেলে নতুন সিটি সেলের সেলফোন কিনে আনে চড়া দামে। ডান হাত প্যান্টের পকেটে রাখে আর বাম হাতে রাখে নতুন সেল ফোন। এখন আর রিকশায় ওঠে না। চলে ট্যাক্সি ক্যাবে করে। সকালে নাশতা করতে চলে যায় গুলশান-বনানী।
ওর চলাফেরা দেখে সবাই অবাক। সারাদিন ক্লাব এসোসিয়েশন, সমিতি করে বেড়াতে লাগল। এতে করে ওর ঢাকার তেপান্ন গলি চুয়ান্নটা চেনা হয়ে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারল না। পরে পাশ কোর্সে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েতিন বছর চোখমুখ বন্ধ করে পড়ার টেবিলে সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকল। শুধু খাওয়া, ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া বাকিটা সময় পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএসের পড়া শুরু করে। কলেজ আর লাইব্রেরি এ দুয়ের মধ্যে ওর জীবনপ্রবাহ আটকে থাকে। সে এখন উপলব্ধি করতে পেরেছে জীবনের অর্থ কী। জীবনের পারপাস কী। আসমান-জমিনে খোদার ফয়সালা সবচেয়ে সৌন্দর্যময়। এটা সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে সারাক্ষণ।

ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ করে গ্রামে ফিরে যায়। বাড়িতে ওর মন বসে না। ঢাকায় আসার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। একদিন পুরানো কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে ওয়ারড্রোবের ভেতর ওর মায়ের অলংকারের বাক্সটা চোখে পড়ে। বাক্সটার মধ্যে রয়েছে ইলার লেখা সব চিঠিপত্র। সারা রাত ধরে প্রত্যেকটা চিঠি একবার করে পড়ে নেয়। সকালে উঠে গোসল করে নাশতা না করে বাক্সটা হাতে করে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু সে ইলার ঠিকানা জানে না। শুধু জানে ল্যাবরেটরি স্কুলের উলটো দিকের একটা বাসায় ভাড়া থাকে। লক্ষ্মীপুরে নেমে দোকানে দোকানে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। ছোটো শহর হলেই মানুষ খোঁজা বড়োই কষ্টকর ব্যাপার। বিশ থেকে ত্রিশটা দোকানে বিনয়বাবুর কথা বললে কেউ তাকে চিনে না বলে জানিয়ে দেয়।
পৌষ মাস চলছে। দিন অনেক ছোটো। সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে আসে। ইয়েল খুঁজেই চলে। সে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ইলাকে খুঁজে বের করতেই হবে তার। ওর আমনতগুলো ফেরত দিয়ে সেও চিরদিনের জন্যে ভারমুক্ত হতে চায়। এ অসময়ে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, সাথে হালকা বাতাস। ইয়েল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড় দিয়ে হাবিব লন্ড্রিতে ঢুকে পড়ে। বৃষ্টির কারণে পথচারীরা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সেও একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পাশের বাড়ি থেকে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা কয়েকটা ছেলেমেয়ে নেমে আসে। বৃষ্টির মধ্যেই গেটের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করে,‘এটা কি বিনয় মাস্টারের বাসা?’
ইউনিফর্ম পরা ছেলেটাব বলে, ‘জি।’
‘মাস্টার সাহেব কয় তলায় থাকেন?’
‘তিন তলায়।’
‘মাস্টার সাহেব কি আছেন?’
‘স্যার তো নেই।’
‘ওহ্! বাসায় কেউ নেই?’
‘তা বলতে পারব না।’
ইয়েল এক পা দুই পা করে উপরে উঠে যায়। দুই ইউনিটের বাসা। দেওয়ালে চারটা সুইচ লাগানো আছে। একটাতে লামি অন্যটাতে ইলা লেখা। সুইচে চাপ দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। দুপুরের শেষ প্রান্তে বিকালের প্রথম প্রান্তে ভাতঘুমে ইলা আচ্ছন্ন। উঠবে-উঠবে করে আবার চোখে ঘুম চেপে ধরে। শাড়ির আঁচল আর মাথার চুল ঠিক করতে-করতে এসে দরজা খুলতেই দেখে ইয়েলকে। তাকে দেখামাত্র ওর সমস্ত শরীর দিয়ে হিম শিহরন বয়ে যায়। মাথা থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত মুহূর্তেই শিথিলতা অনুভব করে। জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত হতে থাকে।
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পরে ইলা বলে,‘ওমা! বাসা চিনলে কী করে? সত্যি তুমি এসেছ! আমি ভাবতেই পারছি না। আমার কী যেভালো লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।
‘দুনিয়াটা খুবই ছোটো। চাইলে আরও ছোটো হয়ে আসে। যখন তুমি মন থেকে কিছু চাইবে তখন সমস্ত পৃথিবীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তা দেবার জন্য রাস্তা দেখিয়ে দেবে।’
‘এতদিন পরে কী মনে করে আসলে?’
ইয়েল বলে, ‘শুধু তোমাকে একবার দেখার জন্য এখানে এসেছি।’
ওর কথা শুনে ইলা মাথা নিচু করে নেয়। ওর মনে হতে থাকে যেন কোনো মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তপ্ত বালিয়াড়ির ঝড়ের ভেতরে থমকে গেছে তার জীবনপ্রবাহ। হাতটা ধরে রাখার কেউ নেই। শূন্য,শুধুই শূন্য লাগে চারিদিক। ইয়েলের কথাগুলো ইলার কলিজাতে গিয়ে আঘাত করতে থাকে।
আবার ইয়েল ধীর স্থির হয়ে বলে, ‘আমার কাছে গচ্ছিত তোমার আমানতগুলো দিয়ে গেলাম।’
ওর দিকে না তাকিয়ে ওর পায়ের কাছে চিঠির বাক্সটা রেখে দেয়। ইলা বিস্ফারিত চোখে তাকে একবার দেখে। ইয়েল পকেট থেকে সোনালি লাইটারটা বের করে সিগারেট ধরিয়ে টান দেয়। ওর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া দেখে ইলার দুচোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জ্বল গড়িয়ে পড়ে।
‘তুমি কি আমাকে দেখার ছলে তোমার গুপ্তধন আমাকে দিয়ে গেলে?’
‘তোমার ওগুলো আমাকে খুব অসহায় করে তুলেছিল। যার জিনিস তার কাছেই থাকা মানায়।’
‘তাতে কি তুমি শান্তি পাবে?’
‘শান্তি পাবোকি-না জানি না। তবে বুকের উপর থেকে একটা বোঝা সরে গেল। ভারমুক্ত হতে পেরেছি। তাতেই আমি খুশি।’
‘ওহ্! তুমি খুশি হলে আমিও…’
‘মাস্টার সাহেবকে দেখছি না?’
‘সে স্কুলের কাজে ঢাকা গেছে। ভেতরে আসো।’
‘ধন্যবাদ। একদম সময় কম। আমাকেএখন যেতে হবে।’
‘একটু দাঁড়াও’, বলে ঘরের ভেতরে চলে গেল ইলা। ইয়েল বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে। ধোঁয়া টেনে আকাশের দিকে ছাড়ে। মনে মনে ভাবে, ধোঁয়ার মতো আকাশে মিলে যেতে পারলে ভালো হত। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কখনও কমে আবার কখনও বাড়ে, আর সাথে হালকা বাতাস।
বিয়ের শাড়ির আঁচলের একটা টুকরো অংশ হাতে করে বেশ কিছুক্ষণ পরে ইলা ফিরে এসে বলে,‘এটা পকেটে রাখো।’
‘হায় হায়! কী করেছ তুমি! বিয়ের শাড়ির আঁচল কেউ এভাবে কাটে? মাস্টার দেখলে কী ভাববে বলো তো!’
‘যা ভাবার ভাবুক। আমার তাতে কী আসে যায়?’
হাতের সিগারেটপুড়তে-পুড়তে এসে কখন যে হাতওপুড়ে যাচ্ছে সেদিকে ইয়েলের খেয়াল নেই। সিগারেটে টান দিতে গিয়ে দেখে পুড়ে দুই আঙুলের মাঝে আটকে আছে। আবার একটা সিগারেট ধরায় সাথে সাথে।
‘যাই’,বলে ইয়েল চলতে আরম্ভ করলে অশ্রুভরা দুচোখ নিয়ে ইলা ওর পেছন পেছন সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে আসে। সিঁড়ির প্রথম স্টেপে এক পা দিয়ে ইয়েল পেছন ঘুরে তাকালেইলা শেষবারের মতো বলে,‘আবার কবে দেখা হবে আমাদের?’
‘তোমার হৃদয় জানে’, বলেই ইয়েল হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। (চলবে)

 

আরো পড়ুন